কেবল ষষ্ঠ শ্রেণি দিয়ে যাত্রা নতুন পাঠক্রমের
দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আজ মঙ্গলবার যাত্রা শুরু করছে নতুন কারিকুলাম (পাঠক্রম)। একাধিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে পাইলট প্রকল্প হিসেবে দেশের ৬২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পরীক্ষামূলকভাবে এই পাঠক্রম শুরু হচ্ছে। এরই মধ্যে শিক্ষার্থীদের নতুন পাঠক্রমের বই দেওয়া হয়েছে। একই সময়ে প্রাথমিকে শুরুর কথা থাকলেও প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় বই লেখার কাজই শুরু করা যায়নি।
এর পরও সরকার আগামী বছর থেকে সব প্রাথমিকের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন পাঠক্রম চালু করতে চায়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুরুতে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি নিয়ে পরীক্ষামূলক পাঠক্রম চালুর কথা ছিল। কিন্তু আজ মঙ্গলবার শুধু ষষ্ঠ শ্রেণিতে নতুন পাঠক্রম চালু হচ্ছে। অন্য শ্রেণিগুলোতে কবে হবে, কেউ বলতে পারেননি।
নতুন পাঠক্রমে শিখনকালীন (শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী কতটুকু শিখল) মূল্যায়নে জোর দেওয়া হয়েছে, যার দায়িত্ব নিতে হবে শিক্ষকদের। কিন্তু আমাদের সব শিক্ষক দক্ষ নন। এমনকি অনেক শিক্ষকেরই এখনো ব্যাচেলর ইন এডুকেশন (বিএড), মাস্টার ইন এডুকেশনের (এমএড) মতো মৌলিক প্রশিক্ষণ নেই। আর শিখনকালীন মূল্যায়নে জোর দিতে হলে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, ল্যাবরেটরিসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র দরকার, যা এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যেসব বিদ্যালয়ে পাইলটিং হচ্ছে, সেগুলোর প্রত্যেক বিষয়ের একজন করে শিক্ষককে নতুন পাঠক্রমের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এমনকি প্রধান শিক্ষক ও উপজেলা পর্যায়ে একজন করে একাডেমিক সুপারভাইজারকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে আমরা জেলা পর্যায়ে কো-ট্রেইনার তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি। তাঁরা উপজেলা পর্যায়ে মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করবেন। সারা দেশে নতুন পাঠক্রম শুরুর আগে মাস্টার ট্রেইনাররা সব শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেবেন। ’
অধ্যাপক মশিউজ্জামান আরো বলেন, ‘নতুন পাঠক্রমে যেসব পদ্ধতির পরিবর্তন হয়েছে, সেগুলো কাজ করছে কি না, তা দেখার জন্যই এই পাইলটিং। এক শ্রেণিতে এটি ঠিক থাকলে সব শ্রেণিতেই ঠিক থাকবে। ’
এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় অর্থের ছাড় না হওয়ায় আমরা এখনো নতুন পাঠক্রমের বই লেখার কাজ শুরু করতে পারিনি। তবে নতুন সচিব আমাদের জানিয়েছেন, শিগগিরই অর্থ ছাড় করা হবে। অর্থ পেলে বই লেখা ও ছাপানোতে এক-দেড় মাসের বেশি সময় লাগবে না। এর পরই আমরা ৬২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে পাইলটিং শুরু করব। ’
এসিটিবি সূত্র জানায়, নতুন পাঠক্রমে প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত থাকছে শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন। অর্থাৎ এসব শ্রেণির শিক্ষার্থীদের কোনো পরীক্ষায় বসতে হবে না। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে ৬০ শতাংশ শিখনকালীন মূল্যায়ন ও ৪০ শতাংশ সামষ্টিক মূল্যায়ন থাকবে। এ ছাড়া জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ে শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন থাকবে।
নবম ও দশম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে ৫০ শতাংশ শিখনকালীন মূল্যায়ন ও ৫০ শতাংশ সামষ্টিক মূল্যায়ন থাকবে। এ ছাড়া জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্প সংস্কৃতি বিষয়ে শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে। আর দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপর পাবলিক পরীক্ষা হবে।
একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে আবশ্যিক বিষয়ে ৩০ শতাংশ শিখনকালীন মূল্যায়ন এবং ৭০ শতাংশ সামষ্টিক মূল্যায়ন করা হবে। নৈর্বাচনিক ও বিশেষায়িত বিষয়ে সামষ্টিক মূল্যায়নের পাশাপাশি প্রকল্পভিত্তিক, ব্যাবহারিক ও অন্যান্য উপায়ে শিখনকালীন মূল্যায়নের সুযোগ থাকবে। প্রয়োগিত বিষয়ে শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন ব্যবস্থা থাকবে। এ ছাড়া একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপর প্রতি শিক্ষাবর্ষ শেষে একটি করে পরীক্ষা হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষার ফলাফলের সমন্বয়ে চূড়ান্ত ফল নির্ধারিত হবে।
২০২৪ সাল থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বিভাগ বিভাজন উঠে যাচ্ছে। অর্থাৎ ওই বছর থেকে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা নামে শিক্ষার্থীদের আলাদা বিভাগ নিতে হবে না। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শুক্র ও শনিবার দুই দিন সাপ্তাহিক ছুটি থাকবে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পাইলটিংয়ের সাফল্যের ওপরই নির্ভর করছে নতুন পাঠক্রমের বাস্তবায়ন। শিক্ষকরা কতটুকু আত্মস্থ করতে পারছেন বা শিক্ষার্থীরা কতটুকু শিখছেন, তা দেখার জন্য তৃতীয় কোনো পেশাদার সংস্থাকে দায়িত্ব দিতে হবে। শিখনকালীন মূল্যায়ন অবশ্যই ভালো। কিন্তু শিক্ষক যোগ্য না হলে, তাঁর নৈতিকতা না থাকলে তিনি সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারবেন না। ’
ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘শিখনকালীন মূল্যায়নের প্রধান উদ্দেশ্য সব শিশুকে সমানভাবে শেখানো। সেটা নিশ্চিত না করে শিক্ষকরা পরবর্তী পাঠ্যসূচিতে গেলে তার ফল ভালো হবে না। এ জন্য শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার বিকল্প নেই। ’
২০১০ সালে গঠিত জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নতুন যেকোনো কিছু বাস্তবায়নে নানা চ্যালেঞ্জ থাকবে। সেসব থেকে উত্তরণে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সেটিই বড় বিষয়। শিক্ষকদের শুধু প্রশিক্ষণ দিলেই হবে না, নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ’
কাজী ফারুক আহমেদ আরো বলেন, ‘করোনায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হয়েছি। ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে নতুন পাঠক্রমে নির্দেশনা রাখতে হবে। শিক্ষাকে আঞ্চলিকীকরণ ও শিক্ষকদের জবাবদিহি থাকতে হবে। ’