শিক্ষাঙ্গন

ডাকসুর স্বপ্ন পূরণে বড় বাধা ভিপি-জিএস দ্বন্দ্ব!

দীর্ঘ ২৮ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ছয় মাস পূর্তি হয়েছে। মেয়াদ বাকি আছে আরও ছয় মাস। অবশ্য এর মধ্যেই সাধারণ শিক্ষার্থীরা হিসাব কষতে শুরু করেছেন, কী পেলেন নির্বাচিত ডাকসু থেকে। নির্বাচনের আগে প্রার্থীরা যে সকল প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট প্রচারণা করেছেন, তার কে কত শতাংশ পূরণ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেইসবুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গ্রুপে প্রতিদিন এ বিষয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের মতে, নির্বাচিত ডাকসু থেকে তারা যা প্রত্যাশা করেছিলেন, তার বেশিরভাগ পাননি। এর পেছনে ডাকসু ভিপি এবং জিএস-এর দ্বন্দ্বকে অনেকেই দায়ী করছেন।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ডাকসু ২৮ বছর ধরে অনির্বাচিত ছিল, এখন নির্বাচিত একটি পরিষদ আছে। এর বাইরে উল্লেখ করার মতো পার্থক্য নেই। বাস্তবে খোঁজ নিয়েও জানা গেছে, ডাকসুর নির্বাচিত পরিষদ এখন অনেকটা নিষ্ক্রিয়। শীর্ষ নেতৃত্বের দূরত্বে ডাকসুর ব্যানারে এখন কোনো সভা-সমাবেশ হচ্ছে না। মাসিক সভা কিংবা ডাকসু থেকে দীর্ঘমেয়াদী কোনো পরিকল্পনাভিত্তিক কর্মসূচি নেই। ভোটের আগে প্রার্থীদের দেওয়া ইশতেহার পূরণেও কারো মনোযোগ নেই।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ডাকসুর শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে মানসিক দূরত্ব প্রকট। ভিপি ও জিএসের মধ্যে কেউই তা রাখঢাকের চেষ্টাও করেন না। এক বছর মেয়াদের ছয় মাস পার করেও নিজেদের অভিষেক অনুষ্ঠানই এখনও করতে পারেনি এই সংসদ। বিজয়ী নেতাদের ইশতেহার পূরণের কোনো চেষ্টাই লক্ষ্য করা যায় না। সমস্যার আধিক্য, ডাকসু নেতৃবৃন্দের নিস্ক্রিয়তা, সদিচ্ছা ও অর্থায়নের অভাব এবং সমন্বয়হীনতাই এসবের মূল কারণ বলে জানা যায়।
ডাকসুতে নির্বাচিত ছাত্রলীগ ও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের দুই প্যানেলেরই নির্বাচনি ইশতেহার ছিল- বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সংকট নিরসন, গণরুম-গেস্টরুম প্রথা উচ্ছেদ, অছাত্র-বহিরাগত বিতাড়ন, সান্ধ্যকালীন বাণিজ্যিক কোর্স বন্ধ, গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, পরিবহন সমস্যার সমাধান, ক্যান্টিনে খাবারের মান বৃদ্ধি, সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল, ক্যাম্পাসে বাইরের যান চলাচল বন্ধসহ নির্বাচনি ইশতেহারের বড় অঙ্গীকারগুলোর বিষয়ে এখনও দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ডাকসুতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রলীগের সঙ্গে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাদের দ্বন্দ্ব নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে ডাকসুর কার্যক্রমে। ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুরের সঙ্গে জিএস গোলাম রাব্বানীর মানসিক দূরত্বও অনেক বেশি। শীর্ষ নেতৃত্বের এই দূরত্ব ও দ্বন্দ্বের কারণে ডাকসুর কার্যক্রম এক প্রকার স্থবির। কোনো কিছুতেই তারা দু’জন একমত হতে পারছেন না।
সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা অভিযোগ করেন, নির্বাচনের ছয় মাস পার হলেও নির্বাচিত নেতারা প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ। নির্বাচনের আগে দেওয়া ইশতেহার অনুযায়ী কোনো প্রার্থীই দৃশ্যমান কোনো কাজ করেননি। বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়া হলেও সম্মিলিতভাবে ডাকসুর বড় ধরনের কোনো কার্যক্রম নেই। তবে ধারাবাহিকভাবে সব সমস্যারই সমাধান হবে বলে ডাকসু নেতৃবৃন্দ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আশ্বস্ত করছেন। কয়েকটি বিভাগ ও হলে ফি কমানো, সেন্ট্রাল লাইব্রেরি ও সুইমিংপুলের সময় কিছুটা বাড়ানো আর কিছু অনুষ্ঠান বাদে ডাকসু তেমন কোনো কাজই করেনি বলে অভিযোগ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন শামিম।
তিনি বলেন, ডাকসুর ইশতেহার কার্যত শুধু কাগজ-কলমেই। এর বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম খান বলেন, নির্বাচনে প্রার্থীরা যে পরিমাণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার অনেকাংশই পূরণে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। ২৮ বছরে সমস্যার পাহাড় জমেছিল। আর নির্বাচিত হওয়ার পর ডাকসু নেতাদের অনেকেই নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন। এদিকে সদিচ্ছা ও অর্থায়নের অভাবেও বাস্তবায়নযোগ্য অনেক ইশতেহার পূরণ হচ্ছে না। যার দরুণ গত ছয় মাসে ডাকসু নেতারা কোনো সাফল্যই দেখাতে পারেননি।
ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর এসব অভিযোগ স্বীকার করে নিয়ে বলেন, ডাকসুর পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিষয় তথা নজরুল, রবীন্দ্রনাথসহ বিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে সেমিনার এবং বেশকিছু সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামের আয়োজন করা হয়েছে। তবে মোটা দাগে শিক্ষার্থীদের যে মৌলিক চাহিদা রয়েছে, সেটা নিয়ে এখন পর্যন্ত আমরা কিছুই করতে পারিনি। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের যে প্রধান সমস্যা আবাসিক সংকট নিরসন করা এবং হল থেকে অছাত্র-বহিরাগত বিতাড়ন করে বৈধ শিক্ষার্থীদের সিট দেওয়ার বিষয়টি কার্যকর হয়নি। এক্ষেত্রে প্রশাসনের অসহযোগিতা এবং ছাত্রলীগের প্রতিবন্ধকতার কারণে এসব সম্ভব হয়নি।
তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা যদি স্বত:স্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসে, তবে ডাকসুকে কার্যকর করা সম্ভব।’ ডাকসুর জিএস গোলাম রাব্বানী ব্যর্থতার বিষয়ে একমত নন। তিনি বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর এই ছয় মাসে কমপক্ষে ৬০ থেকে ৭০টি প্রোগ্রাম সফলভাবে করেছি। সীমাবদ্ধতার কারণে আমাদের প্রয়োজনীয় প্রোগ্রমগুলো এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছি না।
তিনি আরও বলেন, যখনই শিক্ষার্থীরা কোনো প্রয়োজন নিয়ে আমাদের কাছে এসেছে, তাৎক্ষণিকভাবেই সেগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নিয়েছি। আমাদের মূল যে সমস্যা, আবাসিক সংকট, এর জন্য আমাদের আরও হল লাগবে। রাতারাতি তো আর হল করা সম্ভব নয়। এ ব্যাপারেও আমরা আলোচনা করেছি।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button