জাতীয়

কোন টিকায় কতখানি সুরক্ষা

এখন আর কারও অজানা নেই যে, স্বাস্থ্যবিধি মানা কিংবা লকডাউন-শাটডাউন নয়; বিশ্বব্যাপী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মানুষকে টিকা দেওয়ার মধ্য দিয়েই করোনার অবসান ঘটাতে হবে। তবে, বিশ্ব এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে, যখন ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দুনিয়াজুড়ে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে টিকার কার্যকারিতা কমিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, মডার্না, স্পুটনিক ভি, ফাইজার-বায়োএনটেক, জনসন অ্যান্ড জনসন, সিনোফার্মা ও সিনোভ্যাকের করোনা-প্রতিরোধী টিকা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এই টিকাগুলোর মধ্যে কোনটি কতখানি কার্যকর, তা নিচে তুলে ধরা হলো।
ফাইজার-বায়োএনটেক
ফাইজারের টিকাটি দুই ডোজের। প্রথম ডোজের ২১ দিন বা তিন সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ নিতে হয়। সম্প্রতি ফাইজার জানিয়েছে, তাদের দুই ডোজ টিকা নেওয়া ব্যক্তির শরীরে এর কার্যকারিতা ৯৬ দশমিক  ২ শতাংশ। দুই ডোজ টিকা নেওয়ার প্রথম সপ্তাহ থেকে দুই মাস এ কার্যকারিতা অক্ষুণ্ন থাকে। এর পর প্রতি দুই মাসে ৬ শতাংশ করে কার্যকারিতা কমতে থাকে।
তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে টিকাটি ৯৫ শতাংশ কার্যকর বলে জানা যায়। গত মার্চের শেষের দিকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) পক্ষ থেকে ৩ হাজার ৯৫০ জন ফ্রন্টলাইনারের মধ্যে চালানো গবেষণায় দেখা যায়, ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে এটি কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। এটি যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকার মিউট্যান্ট ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রেও ৯৫ শতাংশ কার্যকর বলে ইয়ালে ইউনিভার্সিটির গবেষণায় দেখা যায়।
মডার্না
এই টিকা দুই ডোজের। প্রথম ডোজের ২১ দিন বা তিন সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ নিতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসির এক গবেষণার বরাত দিয়ে এনবিসি বস্টনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মডার্নার টিকার এক ডোজ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে ৮০ শতাংশ এবং দুই ডোজ ৯০ শতাংশ পর্যন্ত সুরক্ষা দিতে পারে।
যুক্তরাজ্যের ওষুধ ও জৈবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মডার্নার টিকায় তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডির মাত্রাও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ৭ থেকে ১০ গুণ পর্যন্ত নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। মডার্না বলেছে, তাদের টিকা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরির ক্ষেত্রে বেটা ভ্যারিয়েন্টের চেয়েও ভালো ফল দেখিয়েছে।
গত মার্চে সিডিসির পক্ষ থেকে ৩ হাজার ৯৫০ জন ফ্রন্টলাইনারের মধ্যে চালানো গবেষণায় দেখা যায়, ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে এটি কার্যকর। অনেক গবেষকের মতে, এ টিকা যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকার মিউট্যান্ট ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রেও কার্যকর। এ নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে।
জনসন অ্যান্ড জনসন
এক ডোজের এই টিকা ১৮ বছরের বেশি বয়সিদের ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত। তবে সম্প্রতি জনসন অ্যান্ড জনসন তাদের টিকার দুই ডোজের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরুর ঘোষণা দিয়েছে। প্রথম ডোজের দুই মাস পর দ্বিতীয় ডোজ নিতে হবে।
এই টিকার মোট কার্যকারিতা ৭২ শতাংশ। আর আগে আক্রান্ত হননি এমন মানুষের ক্ষেত্রে এটি ৮৪ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে এফডিএ বিশ্লেষণে দেখা যায়, যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকার মিউট্যান্ট ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে এটি যথাক্রমে ৬৪ ও ৮২ শতাংশ কার্যকর।
জনসন অ্যান্ড জনসন (জেঅ্যান্ডজে) সম্প্রতি জানিয়েছে, ভাইরাসের মূল ধরনটির বিরুদ্ধে তাদের টিকা যতটা কার্যকর, তার চেয়ে ডেল্টা ধরনের বিরুদ্ধে সামান্য কম কার্যকর। তবে সাউথ আফ্রিকায় শনাক্ত হওয়া বেটা ধরনের চেয়ে ভারতে শনাক্ত ডেল্টা ধরনের বিরুদ্ধে এ টিকা বেশি কার্যকর।
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা
এই টিকাটি দুই ডোজের। প্রথম ডোজের ৪-১২ সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ নিতে হয়। পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের গবেষণার বরাত দিয়ে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার এক ডোজ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে ৩০ শতাংশ কার্যকারিতা দেখিয়েছে। আর দুই ডোজ নেওয়া ব্যক্তিদের ৬৭ শতাংশের ক্ষেত্রে এই টিকা সুরক্ষা দিতে পেরেছে। ইংল্যান্ডে পাওয়া আলফা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার দুই ডোজে ৭৪ শতাংশ কার্যকারিতা দেখা গেছে।
অ্যাস্ট্রাজেনেকার এক ডোজ টিকা পাওয়া ব্যক্তিদের কারও সংক্রমণ ঘটলেও ৭১ শতাংশ মারাত্মক অসুস্থ হননি বা হাসপাতালে যেতে হয়নি। আর দুই ডোজের ক্ষেত্রে এই সুরক্ষার মাত্রা ৯২ শতাংশ।
ইংল্যান্ডের পাবলিক হেলথ বিভাগ থেকে করা এক গবেষণায় দেখা যায়, এ টিকা যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে ৬৬ শতাংশ ও ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ কার্যকর। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে এ টিকা খুব বেশি কার্যকর নয় বলে জানা যায়।
স্পুটনিক ভি
এই টিকাটি দুই ডোজের। প্রথম ডোজের ২১ দিন বা তিন সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ নিতে হয়। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে এ টিকার কার্যকারিতা নিয়ে স্বাধীন কোনো গবেষণা এখনও প্রকাশিত হয়নি। তবে গামালিয়া ইনস্টিটিউট জুনের শেষে দাবি করেছে, করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধেও তাদের টিকা ৯০ শতাংশের মতো কার্যকারিতা দেখিয়েছে।
সিনোফার্ম
এই টিকাটি দুই ডোজের। প্রথম ডোজের চার বা আট সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ নিতে হয়। সিনোভ্যাকের একজন মুখপাত্র আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থাকে বলেন, টিকাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ওপর পরীক্ষা করে তারা দেখেছেন, ডেল্টা ধরনের সংক্রমণের ক্ষেত্রে তাদের টিকার ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করার ক্ষমতা কমে যেতে পারে। তবে দুই ডোজের বুস্টার শট দিলে ডেল্টার বিরুদ্ধেও টেকসই অ্যান্টিবডি তৈরি হতে পারে শরীরে। চায়নিজ সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের সাবেক উপ-পরিচালক ফেং জিয়াং সম্প্রতি চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত সেন্ট্রাল টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, চীনে তৈরি দুটি টিকা ডেল্টা ধরনের বিরুদ্ধে ‘কম কার্যকর’। তবে তিনি টিকা দুটির নাম উল্লেখ করেননি।
সিনোভ্যাক
সিনোফার্মের টিকার মতোই এটি দুই ডোজের। প্রথম ডোজের চার বা আট সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ নিতে হয়। তুরস্ক, চিলি, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও ব্রাজিলে তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা গেছে, এটি করোনার বিরুদ্ধে ৬৫ শতাংশ কার্যকর।
মে মাসের শেষে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা অনুসারে, কোভিড-১৯ প্রতিরোধে সিনোভ্যাক ৬৫ শতাংশ কার্যকর এবং মৃত্যুঝুঁকি কমাতে ৮৬ শতাংশ কার্যকর। ব্রাজিলে সিনোভ্যাক ব্যবহার করে করোনা প্রতিরোধ করা গেছে ৭৫ শতাংশ এবং সেখানে ৯৫ শতাংশ মৃত্যুহার কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
গত ৩১ মে চীনের ন্যাশনাল হেলথ কমিশনের মুখপাত্র মি ফেং দাবি করেন, যেসব মিউট্যান্ট ভ্যারিয়েন্ট এখন পর্যন্ত সামনে এসেছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে চীনের দুই টিকা কার্যকর।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button