জাতীয়দুর্যোগরাজনীতিলিড নিউজ

সম্রাটের খোঁজে র‌্যাব পুলিশের যৌথ অভিযান

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ‘ক্যাসিনো সম্রাট’ ইসমাইল হোসেন সম্রাটের সন্ধানে র‌্যাব-পুলিশের যৌথ অভিযান শুরু হচ্ছে। অবৈধ জুয়া-ক্যাসিনো, টেন্ডার বাণিজ্য, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগে তাকে গ্রেফতারের জন্য আগেই মাঠে নেমেছে র‌্যাব। এবার পুলিশও তাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে।

তবে সম্রাট দেশে আছে না পালিয়ে গেছে তা নিয়ে ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। অসমর্থিত একটি সূত্র জানায়, ইসমাইল হোসেন সম্রাট পলাতক। তিনি পালিয়ে গেছেন। দেশ ত্যাগ করেছেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি তিনি দেশেই আছেন। তাদের নজরদারির মধ্যেই আছেন। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে নজরদারির মধ্যে থাকলে তাকে গ্রেফতারে বিলম্বের হেতু কি।

কেনই বা তাকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে না। গুঞ্জন ছিল যুবলীগ নেতা খালেদের পরই তাকে গ্রেফতার করা হবে। কিন্তু এখনও না হওয়ায় কথার ডালপালা ছড়াচ্ছে। তবে যাতে পালাতে না পারেন সে জন্য সম্রাটের দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। রোববার এ সংক্রান্ত একটি চিঠি দেশের সব বিমান ও স্থলবন্দরে পাঠানো হয়েছে।

এদিকে ভোলা-৩ আসনের সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন ও তার স্ত্রী ফাজানা চৌধুরী এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব স্থগিত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)। মঙ্গলবার সিআইসি থেকে সরাসরি ব্যাংকগুলোতে চিঠি দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী ও আলোচিত এ দুই নেতা এবং তাদের স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়েছে।

সোমবার এ দুই নেতা ও তাদের স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব তলব করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এদিকে গণপূর্তের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ও অতিরিক্ত প্রকৌশলী আবদুল হাইয়ের সব ব্যাংক হিসাব ও লেনদেনের তথ্য তলব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সম্রাট ও খালেদের আয়কর ফাইলও যাচাই হচ্ছে। এর আগে যুবলীগ নেতা জি কে শামীম ও খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার নিজস্ব এবং পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়। ক্যাসিনো ব্যবসা, টেন্ডারবাজি, ঘুষ-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের কয়েক ডজন নেতার বিরুদ্ধে একযোগে মাঠে নেমেছে দেশের প্রায় সব তদন্ত সংস্থা।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে লাপাত্তা এই যুবলীগ নেতা কোথায়, তা বলতে পারছেন না সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদও। সম্রাটের ঘনিষ্ঠ একজন জানান, তিনি (সম্রাট) শনিবার সকাল থেকেই অফিসে আসছেন না। কোথায় আছেন, কেউ বলতে পারছেন না। আমরা অফিসে না পেয়ে তার বাসায় গিয়েছিলাম। সেখানেও তাকে পাইনি। রবি, সোম ও মঙ্গলবারও তিনি কাকরাইলের কার্যালয়ে আসেননি।

এ অবস্থায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে- তাহলে তিনি কোথায়? এমন প্রশ্ন সবার মাঝে। শোনা যাচ্ছে তিনি গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপন করে আছেন।

সূত্র জানায়, এবারের অভিযান চালিয়ে যেতে এবং চাঁদাবাজ সন্ত্রাসী ও অপকর্মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব অত্যন্ত কঠোর- এমন বার্তা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তার কাছ থেকে সরকারের কঠোর মনোভারের কথা জানার পর দিশেহারা হয়ে পড়েন খোদ সম্রাটও। কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। আগে যারা তার কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছেন এখন তাদের অনেকেই তাকে এড়িয়ে চলছেন।

অপর একটি সূত্র জানায়, সম্রাট গ্রেফতার হলে অনেক প্রভাবশালীর নাম প্রকাশ হয়ে যাবে- এমন শঙ্কায় আছেন কিছু নেতা। তাদের কেউ কেউ সম্রাটকে পরামর্শ দিচ্ছেন, গ্রেফতার এড়িয়ে চলতে। তাদের পরামর্শে তিনি নিরাপদ স্থানে আত্মগোপন করেছেন। এ ধরনের নেতার পরামর্শে ও সহযোগিতায় তিনি দেশ ছাড়তে পারেন এমন শঙ্কায় আছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

তাদের মতে, দুর্নীতির চক্রে এদের অনেকেই সম্রাটের দোসর। কেউ কেউ বেশ প্রভাবশালী। তাদের হাতও অনেক লম্বা। এক্ষেত্রে তারা চাইলে বা একটু ঝুঁকি নিলে সম্রাটের জন্য অনেক কিছুই করতে পারেন। তবে সম্রাটের দেশত্যাগের মতো তথ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে নেই।

সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, সম্রাট দেশে আছে বলে তারা মনে করছেন। তথ্যপ্রমাণ সাপেক্ষে সময়মতো তাকে গ্রেফতার করা হবে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, সম্রাটকে গ্রেফতারে কোনো বাধা নেই। শুধু দরকার প্রয়োজনীয় কিছু এভিডেন্স।

গণপূর্তের সেই দুই প্রকৌশলীর ব্যাংক হিসাব তলব : গণপূর্ত অধিদফতরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ও অতিরিক্ত প্রকৌশলী আবদুল হাইয়ের সব ব্যাংক হিসাব ও লেনদেনের তথ্য তলব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। মঙ্গলবার এ মর্মে ব্যাংকগুলোকে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে বিএফআইইউ সূত্র নিশ্চিত করেছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলের (সিআইসি) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ তথ্য তলব করা হয়েছে। অনৈতিকভাবে কাজ পাইয়ে দিতে প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ১১০০ কোটি ও আবদুল হাই ৪০০ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে জানান সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া যুবলীগ নেতা জি কে শামীম। এরপরই তাদের লেনদেন অনুসন্ধান করতে ব্যাংক হিসাব তলব করা হল।

সব সংস্থা একযোগে মাঠে : জি কে শামীমসহ একাধিক নেতার সম্পদ ও ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত সম্পদের সন্ধান করছে দুদক। এদের কর ফাঁকির তদন্ত এনবিআরের হাতে। মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগের তদন্তে মাঠে সিআইডি। ইয়াবাসহ মাদকের তদন্তে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। ক্যাসিনোর ভাগ পেয়েছে এমন পুলিশ কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরির পর তদন্ত করছে ডিএমপি।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে অনুসন্ধানের মাধ্যমে অপরাধীদের তালিকা তৈরির পর র‌্যাবের অভিযান শুরু হয় এক সপ্তাহ আগে। এ অভিযানের ব্যাপ্তি ক্রমেই বাড়ছে। ঢাকা থেকে শুরুর পর ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে।

শুরুটা অবৈধ ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান দিয়ে। প্রথম ধরা পড়ে যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ ভূঁইয়া। এরপর যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা জি কে শামীম, যুবলীগ নেতা ও কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজ।

মঙ্গলবার অভিযান চালানো হয় গেণ্ডারিয়ায়। সেখানে থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও আরামবাগ ওয়ান্ডারল্যান্ড ক্লাবের পরিচালক এনামুল হক ও তার ভাই একই থানা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুপন চৌধুরীর বাসায় অভিযান চালানো হয়। সেখান থেকে নগদ ৫ কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়। সেই সঙ্গে দু’জনের বাসা থেকে ৮ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করে র‌্যাবের টিম। তবে অভিযানের খবর পেয়ে সটকে পড়েন এনামুল হক ও রুপন চৌধুরী।

গ্রেফতার যুবলীগ নেতা (বহিষ্কৃত) খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, জি কে শামীম ও শফিকুল আলম ফিরোজসহ অন্তত ১৫ জন রয়েছেন রিমান্ডে। এদের মধ্যে খালেদের বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও মানি লন্ডারিং আইনে দেয়া হয়েছে তিনটি মামলা। জি কে শামীমের বিরুদ্ধেও একই আইনে তিন মামলা হয়েছে। শফিকুল আলম ফিরোজের বিরুদ্ধে হয়েছে মাদক ও অস্ত্র আইনে দুই মামলা।

এ ছাড়া তাদের সাঙ্গোপাঙ্গদের মধ্যে গ্রেফতার ১১ জনের বিরুদ্ধে হয়েছে একাধিক মামলা। এসব মামলায় জি কে শামীম, খালিদ ও ফিরোজসহ গ্রেফতার সবাই রিমান্ডে আছে।

প্রথমে মনে করা হয়েছিল অভিযান শুধু ক্যাসিনোর অবৈধ ব্যবসায় জড়িতদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু না। গ্রেফতার জি কে শামীম, খালিদ ও ফিরোজ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে তাদের সঙ্গে অবৈধ লেনদেন, ঘুষ আদান-প্রদান ও টাকার ভাগ দিতে হয় এমন অনেকের নাম বলেছে।

এখন তাদের বিরুদ্ধেও অভিযান চলতে পারে। ক্যাসিনো ব্যবসার টাকার ভাগ রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনের কারা পেয়েছেন রিমান্ডে তাদের সবার নাম বলে দিয়েছেন খালিদ। জানা গেছে, এদের নামের একটি তালিকা তৈরি করেছে র‌্যাব। অন্যদিকে জিজ্ঞাসাবাদে জি কে শামীম বলে দিয়েছেন যুবলীগের পদ পেতে কাকে কি পরিমাণ অর্থ দিতে হয়েছে।

মন্ত্রী-এমপি ও সরকারি দফতর ও বিভিন্ন সংস্থার কাকে কত পারসেন্টেজ দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ বাগিয়েছেন সেই তথ্য দিয়েছেন গোয়েন্দাদের। জি কে শামীম ও খালিদের দেয়া তথ্য এখন যাচাই-বাছাই চলছে।

রিমান্ড শেষ হওয়ার আগেই তাদের কাছ থেকে পুরো তথ্য পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট জি কে শামীম ও খালিদ ছাড়াও অভিযানে অর্থ পাচার ও মানি লন্ডারিংয়ে যাদের নাম বেরিয়ে আসছে তাদের বিষয়ে আলাদাভাবে খোঁজখবর নিচ্ছে।

তারা কোন কোন দেশে অর্থ পাচার করেছেন সে বিষয়েও তথ্য সংগ্রহের কাজ করছে। জি কে শামীম ও খালেদের হিসাবে কী পরিমাণ অর্থ আছে- জানতে চাইলে বিএফআইইউর প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান যুগান্তরকে বলেন, এখন পর্যন্ত জব্দকৃত হিসাবে কী পরিমাণ টাকা আছে, তা জানা যায়নি। এটি পাওয়া গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানো হবে।

তিনি আরও বলেন, যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাদের হিসাব স্থগিত করা হয়েছে। বাকিদের হিসাবের তথ্য চাওয়া হয়েছে। গোয়েন্দাদের প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক জি কে শামীমের হিসাবে থাকা ৩০০ কোটি টাকাসহ সব হিসাবে লেনদেন স্থগিত করেছে। জানা গেছে, উচ্চপর্যায়ের গ্রিন সিগনালের ভিত্তিতে টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, অনিয়ম ও ঘুষ-দুর্নীতিতে জড়িত সরকারদলীয় একাধিক এমপি, আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের বহু নেতা ও সরকারের বিভিন্ন দফতরের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের একটি তালিকা করা হয়েছে। এতে যুবলীগের আনিস, সেলিম খানসহ অনেকের নাম রয়েছে।

গত শুক্রবার র‌্যাব সদস্যরা জি কে শামীমের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে হানা দিয়ে তাকে গ্রেফতার করেন। জি কে শামীম ও তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কর ফাঁকি দিচ্ছে কি না, তার সন্ধানে নেমেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)। ইতিমধ্যে কর সার্কেল থেকে আয়কর নথি অধিকতর তদন্তের জন্য সিআইসিতে তলব করা হয়েছে।

এ ছাড়া জি কে শামীমের অবৈধ সম্পদ ও শত শত কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে সরকারের বিভিন্ন দফতর থেকে ঠিকাদারি কাজ পাওয়ার অভিযোগে দুদক মঙ্গলবার থেকে অনুসন্ধান শুরু করেছে বলে জানা গেছে।

এর আগে দুদক থেকে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অবৈধ সম্পদ ও দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। জি কে শামীম ও খালিদসহ যাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হচ্ছে, সেসব মামলা তদন্তের ভার পড়েছে সিআইডির ওপর। মাদকের মামলার তদন্তে আছে র‌্যাব ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button