জাতীয়দুর্যোগলিড নিউজ

গ্রেফতার আতঙ্কে দেশ ছাড়ছেন গডফাদাররা

ক্যাসিনো বাণিজ্যসহ দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের মুখে গ্রেফতার আতঙ্কে দেশ ছেড়ে ইতোমধ্যেই পালিয়েছেন ডজন খানেক চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, মাদক ব্যবসায়ী ও ক্যাসিনোর গডফাদাররা। অনেকেই আবার রাজধানী ছেড়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আত্মগোপনে রয়েছেন। এদের মধ্যে কেউ যুবলীগ, কেউ ছাত্রলীগ, কেউ আওয়ামী লীগ আবার কেউ ওয়ার্ড কাউন্সিলর।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী পলাতক এসব নেতারা সবাই কেন্দ্রীয়, মহানগর ও থানা কমিটির নেতা। গ্রেফতারের আতঙ্কে এরা কেউ এখন প্রকাশ্যে আসছেন না।

অন্যদিকে গতকাল রবিবার রাজধানীর মতিঝিল ক্লাব পাড়া এলাকায় অভিযানে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, আরামবাগ ক্লাব ও দিলকুশা থেকে অন্তত ৩০টি ডিজিটাল ক্যাসিনো বোর্ড, মাদক ও নগদ টাকা উদ্ধার করে পুলিশ।

এ বিষয়ে মতিঝিল জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার মিশু বিশ্বাস বলেন, ‘গতকালকের অভিযানে ক্লাবগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ ক্যাসিনো বোর্ড, জুয়ার বোর্ড, মাদকদ্রব্য, উদ্ধার করা হয়েছে। তবে চলমান অভিযানের মুখে আতঙ্কে অনেকেই স্পট ছেড়ে পালিয়েছেন। ফলে কাউকেই আটক করা সম্ভব হয়নি।’

অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরেই ক্লাবগুলো থানার নিকটস্থ এলাকায় চলে আসলেও পুলিশ কিংবা প্রশাসনের নজর কোথায় ছিল এই নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনি বলছেন ৬০টি ক্যাসিনো আছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আপনারা ৬০ জনে কি এত দিন আঙুল চুষছিলেন? তাহলে যে ৬০ জায়গায় এই ক্যাসিনো, সেই ৬০ জায়গার থানাকে অ্যারেস্ট করা হোক। সেই ৬০ থানার যে র‌্যাব ছিল, তাদের অ্যারেস্ট করা হোক।’

এদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সূত্রে জানা যায়, দুই শিফটে পরিচালিত হওয়া এই ক্লাবগুলো রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হত। জানা যায়, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মো. আবু কাউছার। আরামবাগ স্পোর্টিং ক্লাব নিয়ন্ত্রণ করে ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মোমিনুল হক সাঈদ। মোহামেডান স্পোটিং ক্লাব ও দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবও নিয়ন্ত্রিত করেন এই কাউন্সিলর। এছাড়া ভিক্টোরিয়া ক্লাবটি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের শীর্ষ এক নেতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত।

গোয়েন্দা সূত্র বলেছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেফতার এড়াতে এরই মধ্যে বিদেশে পালিয়ে গেছেন সেচ্ছাসেবক লীগ উত্তরের সাধারণ সম্পাদক ফরিদুর রহমান খান ইরান, শ্রমিক লীগ সভাপতি পরিবহন নেতা সাদিকুর রহমান হিরু, তেজগাঁও থানা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন, যুবলীগ দক্ষিণ যুগ্ম সম্পাদক মোমিনুর রহমান সাঈদসহ আরও অনেকে।

এদিকে মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের শীর্ষ এক নেতা এরই মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে এলেও তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে খালেদ ও শামীম গ্রেফতারের পর থেকে হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেছেন গডফাদারের তালিকায় নাম উঠা এই নেতার। গ্রেফতার আতঙ্কে গা ঢাকা দিয়েছেন তিনি বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর দফতরে যাওয়া অভিযোগের যাচাই-বাছাই শেষে একটা তালিকা তুলে দেওয়া হয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। যার মধ্যে রয়েছেন যুবলীগ ও কাউন্সিলর।

অন্যদিকে আটক যুবলীগের কেন্দ্রীয় সমবায় বিষয়ক সম্পাদক জি কে শামীম ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা।

গোয়েন্দাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে খোঁজা হচ্ছে ব্রাদার্স ক্লাবের সভাপতি যুবলীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন মহি, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রেজা, সাংগঠনিক সম্পাদক গাজী সরোয়ার হোসেন বাবু, সহ-সভাপতি আনোয়ারুল ইকবাল সান্টুসহ এক ডজন নেতাকে। এসব নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, জমি দখল, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা ও ক্যাসিনোর টাকা গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, র‌্যাবের গ্রেফতারের তালিকায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ নেতা, কাউন্সিলরসহ অন্তত ২৫ জন প্রভাবশালী রয়েছেন। যাদের ওপর নজরদারি চলছে। পর্যায়ক্রমে তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

সূত্রের খবরে জানা গেছে, গ্রেফতারের তালিকায় খালেদের সহযোগী রাজু, তুহীনও রয়েছেন। তবে গ্রেফতারের ভয়ে তারাও আত্মগোপনে চলে গেছেন।

অন্য দিকে দুই মামলায় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। শুক্রবার ছিল রিমান্ডের প্রথম দিন।

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে ঢাকার ক্যাসিনো বাণিজ্য, যুবলীগের টেন্ডারবাজি, র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার যুবলীগ নেতা জি কে শামীমসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেফতার অভিযানে নেমেছে গোয়েন্দা পুলিশ।

সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদের শুরুতেই খালেদের কাছে গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা জানতে চান কীভাবে যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের নেতা হয়েছেন। এ ব্যাপারে গোয়েন্দা পুলিশকে এমন সব তথ্য দিয়েছেন, যা শিউরে ওঠার মতো।

বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালের পর যুবলীগের এক শীর্ষ নেতার ছত্রছায়ায় ঢাকার একটি অংশের পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে আসে খালেদের হাতে। আর এলাকায় নিজের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সর্বোচ্চ শক্তির ব্যবহার শুরু করেন তিনি।

দুবাইয়ে আত্মগোপন করা শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। দুবাই ও সিঙ্গাপুরে জিসানের সঙ্গে যুবলীগ দক্ষিণের একজন শীর্ষ নেতাসহ খালেদকে চলাফেরা করতেও দেখেছে অনেকে।

সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সিঙ্গাপুরে হোটেল মেরিনা বেতে জিসান, খালেদ ও যুবলীগের ওই শীর্ষ নেতার মধ্যে ক্যাসিনো এবং ঢাকার বিভিন্ন চাঁদার ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে বৈঠক হয়। সেখানে জিসান তাদের কাছ থেকে ৫ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন।

এ নিয়েই খালেদ ও যুবলীগের ঐ শীর্ষ নেতার মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এছাড়া সম্প্রতি খালেদের সঙ্গে দুবাইয়ে বসে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গেও বিরোধ শুরু হয়েছিল বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতেই যুবলীগের ওই শীর্ষ নেতাকে সরিয়ে দিতে একে-২২ রাইফেলসহ ভারী আগ্নেয়াস্ত্র আনেন খালেদ। এসব অস্ত্র পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ উদ্ধার করে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, এরই মধ্যে কয়েকজন প্রভাবশালীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ যেই দলের হোক কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।

এছাড়া দেশে ক্যাসিনো ব্যবসা চলতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে তিনি বলেন, রাজনৈতিক নেতা হোক, সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি হোক, বা জন প্রতিনিধি হোক, কাউকেই আইনসঙ্গত নয়, এমন ব্যবসা করতে দেব না। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় আমরা সে কাজটিই করছি। প্রধানমন্ত্রীর দিক-নির্দেশনায় চাঁদাবাজি ও আইন বহির্ভূত সব ব্যবসার বিরুদ্ধে কাজ করছি।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button