অসম্পাদিত

কোভিড-১৯ পরিস্থিতিজনিত কারণে টিএমএসএস এর মানবিক কার্যক্রমের নৈতিক সংকট

মোঃ আনিসুর রহমান: বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ ইংরেজ আমুল থেকেই অবহেলিত ছিল। পাকিস্তানী শাসনে বঞ্চিত পূর্ব পাকিস্তানের পূরোধাই ছিল উত্তরবঙ্গ। জনঘন বসতিপূর্ন অস্বাস্থ্যকর শিক্ষা বঞ্চিত, স্যানিটেশন বিবর্জিত, মসজিদ ভিত্তিক মকতব মাদ্রাসায় নিম্নমানের শিক্ষাগ্রহণ, তার মধ্যে জীবন ভিত্তিক কোন শিক্ষনীয় পাঠ্যক্রম ছিল না। শুধুমাত্র মৃত দেহের জানাজা, নামাজ পড়াতে পারলে সেই পরিবার অহমে গদগদ ছিল। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান এইগুলি বঞ্চিত মানুষের বড় ধরনের সান্তনা ছিল, পরকালে তাদের এই রূপ গরিবী পরিস্থিতি দ্বারা ধনী লোকের পাঁচশত বছর পূর্বেই তারা বেহেস্তে প্রবেশ করবে। মাতৃ মৃত্যু, শিশু মৃত্যু, নারীকে অবরোধ বাসীনি রাখা, শিক্ষাহীন সমাজ পরিবারকে অভিজাত গণ্য করা বিশেষ করে স্বরস্বতিকে অসতী গণ্য পূর্বক কোন মহিলার হাতে বইপুস্তক থাকলে তাকে অশনি ভাবা। এই রূপ দারুন দরিদ্রতার দুষ্ট চক্র জেঁকে বসে ছিল উত্তরবঙ্গে।

এই সময় বগুড়া জেলার গোকুল ইউনিয়নস্থ তৎকালীন জমিদার রফাতুল্লাহ তালুকদারের পুত্র আনসার আলী তালুকদার, মাষ্টার নূরুন্নবী, মাষ্টার মরহুম ফরিদ উদ্দিন এবং ফাতেমা বেওয়া, আম্বিয়া বেগম এর অবদানে ১৯৬৪ সালে ঠেঙ্গামারা সবুজ সংঘ গঠন হয়। এই সময় গ্রামের উত্তরপাড়ায় বসবাসকারী ৬ষ্ঠ শ্রেনীর ছাত্র পিতৃহীন আব্দুস সামাদ সবুজ সংঘের সদস্য পদ গ্রহণ করে অত্র সংঘের মাধ্যমে মানুষের অধিকার আদায়, বেকারত্ব দূর ইত্যাদি জনকল্যানমূলক কাজে এলাকার আবাল-বনিতা-বৃদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করছেন। কার্যক্রমগুলির অর্থায়নে ডোনার ছিলেন রফাতুল্লাহ তালুকদারের কনিষ্টপুত্র আনসার আলী তালুকদার। তিনি আব্দুস সামাদ থেকে পরিবর্তিত হোসনে-আরা বেগম এর স্বামী। আমার জীবনের দেশ বিদেশের অবস্থান অভিজ্ঞতা এরূপ একই গ্রামের বাসিন্দা কিশোর জীবন থেকে প্রবীন জীবন কাল পর্যন্ত জীবন সঙ্গী হিসেবে আদর্শিক আনসার আলী তালুকদার দম্পতির অসামান্য অবদানে ১৯৮০ সাল থেকে নতুন রূপে নতুন দর্শনে ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ নামে তার মূল স্টিয়ারিং এ আছে এই দম্পতির স্ত্রী হোসনে-আরা বেগম। একটি অখ্যাত গ্রাম থেকে অতি দরিদ্রদের অধিক অবদানে জন্ম নেওয়া ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ (টিএমএসএস) এর প্রাতিষ্ঠানিক আইনগত সরকারী স্বীকৃত নিবন্ধন বিদ্যমান। সংস্থাটির বিকাশ বিস্তার সমগ্র বাংলাদেশে। আমার সৌভাগ্য হয়েছে সচিবালয়ে কর্মরত অবস্থায় এই সংস্থাকে সর্বতো সহযোগিতা করা। আমার অবসর জীবনেও আমি এই সংস্থাকে অবদান দিয়ে আসছি। সংস্থাটির ব্যাপ্তি সমগ্র বাংলাদেশে ১৬০০টি অফিস, ভূ-সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ৭০০০ বিঘা, ৩৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মেডিক্যাল কলেজ, নার্সিং কলেজসহ হাজার বেডের হাসপাতাল, পাঁচ তারকা হোটেল, বিশেষজ্ঞ ও পন্ডিতদের পরিভ্রমনে এ্যাভিয়েশন কোম্পানী, বিশ্ববিদ্যালয় এইগুলি অবদানে নি:সন্দেহে তারা মানবিক কাজ করে যাচ্ছে।

কিন্তু ক্ষুদ্রঋণের ১৫ লক্ষ পরিবার গ্রাহক, লক্ষাধিক ক্ষুদে সমিতির সবাই উন্নয়ন তৎপরতার মূলমন্ত্র সেবা, মানবিকতা, কল্যাণ ও উন্নয়ন তৎপরতা, কোভিড-১৯ পরিস্থিতি জনিত কারণে সংস্থার ৩৩ হাজার জনবলকে তাদের নিয়মিত বেতন ভাতাদি দিতে অক্ষম হয়ে নৈতিকতার লঙ্ঘনে পড়ে সংস্থার নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপিকা ড. হোসনে-আরা বেগম সমগ্র বাংলাদেশের কর্মকর্তাসহ কর্মীদের সহিত অতি সম্প্রতি ০৫ দিন ব্যাপী ভিডিও কনফারেন্সে যে সুচনা বক্তব্য দেন তা নিম্নরূপঃ

বৈশ্বিক করোনা পেন্ডামিক পরিস্থিতি প্রেক্ষিত টিএমএসএস

ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ (টিএমএসএস) এর জন্মস্থান সুবিধা-বঞ্চিত উত্তরবঙ্গের বগুড়া জেলার ঠেঙ্গামারা নামক গ্রামে। সংস্থাটির জন্ম বৈচিত্র্যতা এবং ভিন্নতাজনিত কারণে গ্রামীণ কৃষি ভিত্তিক হত দরিদ্র পরিবারের জনগোষ্ঠিই সংস্থার জন্মলগ্ন থেকে টিএমএসএস কে বেষ্টিত করে আছে। স্বাভাবিক ও সংগত কারণে সংস্থার মূলনীতির অন্যতম নীতি হচ্ছে তৃণমুল পর্যায়ের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন এবং বিকেন্দ্রীকরণ। ফলশ্রুতিতে টিএমএসএস এর কর্ম বহুমুখীতা এবং কর্মঘনত্ব উত্তরবঙ্গে তথা বগুড়াতে বেশী। টিএমএসএস এর অন্যতম ব্যতিক্রমতা সংস্থাটির সম মর্যাদা সম্পন্ন প্রধান কার্যালয় ঢাকা এবং প্রতিষ্ঠা কার্যালয় তথা ফাউন্ডেশন অফিস উত্তরবঙ্গের বগুড়ায়।

ফাউন্ডেশন অফিস এবং প্রধান কার্যালয় সমমান তথা সমক্ষমতা সম্পন্ন হলেও বাংলাদেশের রাজধানী তথা রাষ্ট্রিয় ক্ষমতা বলয় সান্নিধ্যে প্রধান কার্যালয়ই ঢাকায় অবস্থিত। টিএমএসএস এর প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালককে প্রাতিষ্ঠানিক কারণে, পারিবারিক কারণে এবং সংস্থায় জন্মকালে ভূমিকাকারী শ্রেনীভূক্তগণের চাহিদাজনিত কারণে ফাউন্ডেশন অফিস এখতিয়ারে আবাসিক ভাবে/ওয়ার্কিং ডেক্স থাকলেও প্রধান কার্যালয়ে প্রত্যেক মাসেই একাধিক বার ঢাকায় গিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রিয় ক্ষমতাবলয় এর সহিত যোগাযোগ রাখতে হয় মাত্র। টিএমএসএস এর প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত ES এখতিয়ারাধীন International Desk বা কর্মরত সরকারী অবসর প্রাপ্ত পরামর্শক এবং উপদেষ্টাগণের নিকট থেকে কোভিড-১৯, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে গণ চীনে ভয়াবহ মহামারী আকারে প্রকাশিত হলেও তাদের নিকট থেকে তাৎক্ষনিক বা আগাম হুশিয়ারী/পরামর্শ মৌখিক বা লিখিতভাবে পাওয়া যায় নাই। আমার কোন সহকর্মীর নিকট থেকে ভয়ংকর কোভিড-১৯ এর বিষয়ে কোন লিখিত বা মৌখিক প্রস্তাবনা পাই নাই। আমার নিজের পক্ষেও এই বিষয়ে আগাম কোন হুশিয়ারী দায়িত্ব বা পালনীয় কিছু করার তাগিদ বোধ করি নাই। অথচ অনেক ছোট ও বড় সংগঠন এই বছরের জানুয়ারী মাস থেকেই নাকি করোনা ভাইরাসের মোকাবেলার নিমিত্তে অর্থনৈতিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, যার অন্যতম উদাহরণ লিকুইডিটি মেইনটেইন করা, অর্থ ব্যবস্থাপনা করা।

প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আদর্শিক হতে গিয়ে লিকুইডিটি মেইনটেইন করার ক্ষেত্রে হয়তোবা অন্যতম অন্তরায় ছিল টিএমএসএস এর লিকুইডিটি পেনাল্টি নামক বিধান। ফলশ্রুতিতে যা হয়েছে, টিএমএসএস এর সঞ্চয়কারী বিপুল সংখ্যক সদস্যগণকে ঋণের অপেক্ষায় থাকতে হয় নাই। তারা ঋণ চেয়েছে, ঋণ পেয়েছে, তাদের কর্মসংস্থান হচ্ছে। তাদেরকে ত্রাণের উপরে আচড়ে পড়তে হচ্ছে না। এর পড়েও আপনারা তাদেরকে ত্রাণ পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণভাবে অপরিসীম প্রচেষ্টা করছেন, এই জন্য আপনাদেরকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ, মোবারকবাদ জানাচ্ছি। আপনারা খোদাতায়ালার পরিভাষায় নেতা, আপনাদের আসন মহান সৃষ্টি কর্তার পক্ষ থেকে তার ঘোষণা মোতাবেক সুদৃঢ় হবে, উন্নতি হবে, বংশ পরম পরায় আপনারা সমৃদ্ধ হবেন, সম্মানিত হবেন।

প্রিয় সহকর্মীবৃন্দ,
বৈশ্বিক কোভিড-১৯ পেন্ডামিক শতাব্দির ইতিহাস হিসেবে আপনারা ঐতিহাসিক যোদ্ধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্মরনীয় ও বরনীয়। কিছু সংখ্যক আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তিত্ব যারা তেমন নিডি নয় অথচ গ্রীডি, তারা কুখ্যাত ব্লগার এর কুমন্ত্রনায় আপনারা বিভ্রান্ত হবেন না, ধৈর্য ধারণ করুন। ধৈর্যশীলদের অতি নিকটে পরম করুনাময় আল্লাহ্তায়ালা আছেন। এতো নিকটে আছেন, যা আপনার মেরুদন্ডের সাহারা, ঘাড়ের রগ থেকেও নিকটে। আমাদের এই দুর্দিন থাকবে না। আজকে যারা আপনাদের থেকে বেশী পাচ্ছে, বেশী ভোগ করছে, সুবিধা নিচ্ছে, আপনারা লিখে রাখুন, খুব শীঘ্রই আপনারা তাদের থেকে অনেক বেশী সুযোগ সুবিধা পাবেন, ভোগ করবেন ইনশাল্লাহ। যেহেতু আমাদের সংগঠনের কৃষিভিত্তিক সম্পদ (জমি জমা) এবং সম্ভার অনেক বেশী ও মজবুত, মাঠ পর্যায়ে, সদস্য পর্যায়ে সঞ্চয়কারী ঋণ গ্রহীতার সংখ্যার সাম্যতা আছে। সঞ্চয়কারী সদস্যের সংখ্যা, ঋণ প্রত্যাশী সদস্য অপেক্ষা অনেক বেশী নয়। ফলে সদস্যদের পারিবারিক অর্থনীতি সহনশীল থাকবে, টিএমএসএস এর বহুমুখী কার্যক্রম বিশেষ করে স্বাস্থ্য সেক্টর, আইটি সেক্টর এর দ্বারা পোস্ট করোনা বাংলাদেশে তথা বিশ্বে সমাদৃত হবে। আগামীতে টিএমএসএস কে অতি উপযুক্ত ভেবেই দেশী-বিদেশী বিভিন্ন অর্থায়নকারী কর্তৃপক্ষ বিপুল অর্থ দিতে অধীর আগ্রহ প্রকাশ করছে। ফলে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম আরও জোরদার হবে। কর্মী বাঁচলে সংস্থা বাঁচবে, তা যেমন সত্য, তা থেকে শত গুন সত্য, সংস্থা বাঁচলে কর্মী বাঁচবে, কর্মীর নিকটতম জনগোষ্ঠি বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জন্য বাঁচবে। তাই আমার অনুরোধ, ধৈর্য ধরুন। করোনা কমপ্লাইন্স করে স্বাস্থ্য বিধি মেনে কাজ করুন, কাজ না করলে পারিতোষিক দাবীদারিত্ব বৈধ নহে। অনুমান করা যাচ্ছে, ভ্যাকসিন ও ঔষধ আবিস্কার পরীক্ষিত হওয়া এবং সমগ্র পৃথিবীতে ব্যবহার গুটি বসন্ততুল্য করোনা মুক্ত দেশ হিসেবে ঘোষনা না করা পর্যন্ত করোনাকে কমপ্লাইন্স করেই আমাদের ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, প্রাতিষ্ঠানিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন-যাপন করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সহায়ক হোক।

-অধ্যাপিকা ড. হোসনে-আরা বেগম
  নির্বাহী পরিচালক, টিএমএসএস

মানবিক টিএমএসএস এর বিশাল বিত্ত বৈভব, স্থায়ী সম্পদ রেখে এ বক্তব্য দিয়ে এই দুর্দিনে সংস্থার কর্মীদেরকে সামাল দিতে পারবেন কি? তাই আমার পরামর্শ প্রয়োজনে টিএমএসএস এর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বেতন স্থগিত রেখে তাদের জমানো টাকা, আজীবন সদস্য, অসংখ্য উপদেষ্টা, বিত্ত বৈভবপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের নিকট থেকে করজে হাছানা না নিয়ে, নগন্য বেতনের কর্মীদের নিকট থেকে করজে হাছানা চাওয়া নৈতিকতার মানবিক টিএমএসএস এর নৈতিকতা লঙ্ঘন বলে এই প্রতিবেদক মনে করে। তারপরও প্রধান নির্বাহী জ্ঞানবান পরামর্শকদের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে সুসিদ্ধান্ত নিতে পারেন কারন মহিরূহসম এই প্রতিষ্ঠান নস্ট হতে দেয়া যেতে পারে না।

প্রতিবেদকঃ
সম্পাদক, দৈনিক সংবাদ কণিকা

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Back to top button