অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৯০-এর ১৯ ধারায় অভিভাবক হিসেবে বাবাও অযোগ্য হতে পারেন। তিনি চারিত্রিকভাবে অসৎ হলে, সন্তানের মা অর্থাৎ স্ত্রীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করলে, যদি মাদকাসক্ত এবং অধার্মিক হন, শিশুদের প্রতি অমানবিক আচরণ করেন, প্রকাশ্যে লাম্পট্য করেন, দুস্থ অথবা নিঃস্ব হন অথবা স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে এ সংক্রান্ত কোনো চুক্তি থাকে, বাবা ফের বিয়ে করেন এবং নাবালক সন্তানের ভরণপোষণ দিতে অবহেলা করেন। অভিভাবকের অন্যতম দায়িত্ব হলো প্রতিপাল্য অর্থাৎ নাবালক সন্তানের ভরণপোষণ, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সব ব্যাপারে নৈতিক এবং অর্থনৈতিক সব সুবিধা সন্তানকে দেয়া। প্রচলিত একটি ধারণা রয়েছে, মা আবার বিয়ে করলে নাবালক সন্তানের জিম্মাদারির অধিকার হারান। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে আদালত সব ঘটনা ও অবস্থা বিবেচনা করে নাবালককে তার মায়ের পুনর্বিবাহের পরও সে মায়ের জিম্মায় রাখার আদেশ দিতে পারেন।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সন্তানকে আটকে রেখে স্ত্রীকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন স্বামী। ওই পরিস্থিতিতে স্ত্রী নাবালক শিশু, এমনকি সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হলেও জিম্মার আবেদন জানালে আদালত সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সন্তানের জিম্মা মাকে দিতে পারেন। অভিভাবকত্ব এবং নাবালক সন্তানের জিম্মাদারিত্বের জন্য পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। এ ছাড়া আদালতের বাইরে উভয় পক্ষ সমঝোতার মাধ্যমে বা কারো মধ্যস্থতায়ও এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। পারিবারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে জেলা জজের আদালতে আপিল করা যায়। আদালতের মাধ্যমে প্রতিপাল্যের বিষয়ে কোনো আদেশ দেয়া হয়ে থাকলে যদি কেউ আদালতের এখতিয়ারের সীমা থেকে নাবালককে সরিয়ে নেয়, তাহলে আদালতের আদেশে ওই ব্যক্তি অনূর্ধ্ব এক হাজার টাকার জরিমানা অথবা ছয় মাস পর্যন্ত দেওয়ানি কারাবাস ভোগ করতে বাধ্য থাকবে। ওই দেওয়ানি কারাবাসের খরচসহ মামলার খরচ এ আইন মোতাবেক হাইকোর্ট ডিভিশনে প্রণীত কোনো বিধি সাপেক্ষে যে আদালতে মামলাটি চলছে; তার বিবেচনার ওপর নির্ভর করে আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।
ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সন্তানের অভিভাবকত্ব : মুসলিম আইন মোতাবেক বাবা হলেন নাবালক সন্তানের শরীর ও সম্পত্তির স্বাভাবিক অভিভাবক। বাবার অভিভাবকত্বের ব্যাপারে তার অধিকারের সমর্থনে আদালত কর্তৃক কোনো আদেশ দেয়ার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু মা-বাবার মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটলে বা কারো মৃত্যু হলে অথবা উভয়ে একত্রে বসবাস না করলে, সাধারণত সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে মামলা হয়ে থাকে।
পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ অনুসারে নিম্নলিখিত ব্যক্তিরা নাবালকের সম্পত্তির অভিভাবক হওয়ার অধিকারী : অগ্রগণ্যতার ক্রম অনুযায়ী বাবা, বাবা কর্তৃক নিয়োগকৃত ব্যক্তি; বাবার বাবা অর্থাৎ দাদা, দাদা কর্তৃক নিয়োগকৃত ব্যক্তি। যদি এসব ব্যক্তি না থাকেন, তাহলে আদালত কর্তৃক নিয়োগকৃত আইনগত অভিভাবকই নাবালকের সম্পত্তির অভিভাবক। এ ক্ষেত্রে, মা কেবল একজন তত্ত্বাবধায়ক এবং তিনি নাবালক সন্তানের কোনো সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারেন না, যদি না আদালত কর্তৃক সম্পত্তির অভিভাবক নিযুক্ত হন। এই মা বা নারী তার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সন্তানের অভিভাবক হতে পারেন না আইনগত বিভিন্ন বাধার কারণে।
মা কখন সন্তানের জিম্মাদার হারান : ১. নীতিহীন জীবন যাপন করলে, ২. এমন কারো সাথে তার বিয়ে হলে, যিনি শিশুটির নিষিদ্ধ স্তরের মধ্যে ঘটলে তার ওই অধিকার পুনর্জীবিত হয়, ৩. সন্তানের প্রতি অবহেলা করলে এবং দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে, ৪. বিয়ে বজায় থাকা অবস্থায় বাবার বসবাসস্থল থেকে দূরে বসবাস করলে, ৫. যদি তিনি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করেন, ৬. যদি সন্তানের বাবাকে তার জিম্মায় থাকা অবস্থায় সন্তানকে দেখতে না দেন।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সন্তানের অভিভাবকত্ব : হিন্দু আইনেও নাবালকের প্রকৃত ও স্বাভাবিক অভিভাবক বাবা। বাবা জীবিত অবস্থায় উইল করে অন্য কাউকে নাবালক সন্তানের অভিভাবক নিযুক্ত করে গেলে মা অপেক্ষা সে ব্যক্তির দাবি অগ্রগণ্য হবে। শুধু মা অবৈধ সন্তানের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক অভিভাবক। কিন্তু তার বাবার সন্ধান বা পরিচয় জানা গেলে, বৈধ অভিভাবক হিসেবে বাবার অগ্রাধিকার স্বীকৃত হবে। মা যদি পরে বিয়ে করেন, কেবল এ কারণে তার নাবালক সন্তানের অভিভাবক হওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন না এবং ধর্মান্তরজনিত কারণেও মা অবৈধ সন্তানের অভিভাবক হওয়ার দাবি হারান না।
বৈধ সন্তানের ক্ষেত্রে কোনো হিন্দু বাবা ধর্ম পরিবর্তন করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করলে তার জন্য নাবালক সন্তানের ওপর তার অভিভাবকত্বের অধিকার হারান না। কারণ বাবার ধর্ম অনুযায়ী সন্তানের ধর্ম নির্ধারিত হয়। কিন্তু মায়ের ক্ষেত্রে এ শর্ত প্রযোজ্য নয়। মা ধর্ম পরিবর্তন করলে আদালত মায়ের হেফাজত থেকে নাবালক সন্তানকে অন্য কোনো হিন্দু ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করতে পারেন। যদি কোনো নাবালকের মা-বাবা না থাকে এবং আদালত কর্তৃক নিযুক্ত কোনো অভিভাবকও না থাকে, তখন সাধারণত নাবালকের পুরুষ আত্মীয় তার বিষয়াদি দেখাশোনা করে থাকেন। বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রেও হিন্দু আইন প্রযোজ্য।
খ্রিষ্টানদের ক্ষেত্রেও বাবা স্বাভাবিক অভিভাবক। কিন্তু কোনো বিয়ে ভেঙে গেলে সহজ একটি প্রশ্ন ওঠে, নাবালক সন্তানের অভিভাবকত্ব কে পাবেন? ডিভোর্স অ্যাক্ট ১৮৬৯-তে এ ব্যাপারে কিছু দিকনির্দেশনা রয়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশে প্রচলিত অভিভাবকত্ব-সংক্রান্ত আইন ‘অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৯০’ খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের জন্য প্রযোজ্য। যেকোনো বিয়েবিচ্ছেদ বা জুডিশিয়াল সেপারেশনের সময় আদালত নাবালক সন্তানের অভিভাবকত্ব নির্ণয় করে দেন। এ ব্যাপারে আদালতের নিজস্ব ক্ষমতা রয়েছে।
তবে সন্তানের কল্যাণ বা মঙ্গল প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলে মাকে অভিভাবকত্বের অধিকার দেয়া হলেও তিনি হন আদালত কর্তৃক নিযুক্ত অভিভাবক। যদি মায়ের ধর্মবিশ্বাস ভিন্ন হয়ে যায়, সন্তানকে অবশ্যই তার বাবার ধর্মবিশ্বাসের আলোকে প্রতিপালন করতে হবে। যদি মা এর প্রতিপালনে ব্যর্থ হন, তাহলে সন্তানের অভিভাবকত্ব হারাতে পারেন। আদালত বাবার পিতা অর্থাৎ দাদাকেও অভিভাবকের দায়িত্ব দিতে পারেন, যদি মায়ের অর্থনৈতিক অবস্থা সচ্ছল না থাকে।
বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান। কিন্তু সন্তানের অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে চলছে নানাবিধ বৈষম্য। যে আইন মানবাধিকার রক্ষা করতে পারে না, যে আইন ন্যায়ের নীতিমালা রক্ষা করতে পারে না, যে আইন সংবিধান সমুন্নত রাখতে পারে না, যে আইন সব স্বচ্ছতা, যৌক্তিকতা এবং পদ্ধতিগত সংহতি রক্ষা করতে পারে না, সেই আইন সমতা রক্ষা করতে সক্ষম- এ কথা বিশ্বাস করার কোনো যৌক্তিক অবকাশ আছে কি?
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, আইনগ্রন্থ প্রণেতা
E-mail : [email protected]