জাতীয়দুর্যোগলিড নিউজ

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রাজত্বকারী আলইয়াকিন গ্রুপ

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঢল শুরু হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই আরএসও, আরাকান আর্মি, আরসা ও আলইয়াকিন নামের অনেক সশস্ত্র গ্রুপের নাম ওঠে আসতে শুরু করে। তখন অভিযোগ ওঠে, শরণার্থীদের সঙ্গে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিচ্ছে ওই সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্যরা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, উল্লেখিত দলগুলোর বাংলাদেশে তেমন অস্তিত্ব না থাকলেও এ মুহূর্তে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে রাজত্ব কায়েম করছে আলইয়াকিন নামের সন্ত্রাসী গ্রুপটি। এই দলের কারণে প্রায়শই ঘটছে হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে সব ধরনের জঘন্য অপরাধ। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার যুবলীগ নেতা ওমর ফারুক হত্যার পিছনেও আলইয়াকিন বাহিনী জড়িত বলে অভিযোগ উঠে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, টেকনাফ-উখিয়ার ৩২টি ক্যাম্পেই রাজত্ব করছে আলইয়াকিন বাহিনীর সদস্যরা। দিনের বেলা সাধারণ রোহিঙ্গার বেশ ধরে থাকলেও সন্ধ্যার পরে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে তারা। প্রতিটি ক্যাম্পে ২০-২৫ জনের ১৬-৩০ বছর বয়সী যুবকদের একটি করে গ্রুপ টহল দিতে থাকে সারাক্ষণ। নিজেদের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে খুন করতেও পিছপা হয় না তারা। একই সঙ্গে যে সব রোহিঙ্গার আর্থিক অবস্থা একটু ভালো তাদের অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। চাহিদা মতো টাকা না পেলে অপহরণকারীকে খুন করে গুম করে ফেলা হয়। এখানেই শেষ নয়, মিয়ানমার থেকে নিয়মিত বড় বড় ইয়াবার চালানও আনছে আলইয়াকিনের সদস্যরা। লুট করছে স্থানীয়দের গরু-ছাগল থেকে শুরু করে মূল্যবান সম্পদ।
স্থানীয়দের দাবি, টেকনাফ-উখিয়ার প্রভাবশালী মহল ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে আলইয়াকিন বাহিনীর। বিভিন্ন উছিলায় পরের জমি দখল করতেও ব্যবহার করা হচ্ছে তাদের। আবার স্থানীয়রা রোহিঙ্গাদের কোনো কথা না শুনলে মুহূর্তের মধ্যে দলবেঁধে হাজির হয় তারা। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত দুই বছরে টেকনাফ ও উখিয়াতে ৪২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এগুলোর বেশির ভাগের সঙ্গেই আলইয়াকিন বাহিনী জড়িত বলে জানা গেছে।
৪, ৯, ১০, ২৬ ও ২৭ নম্বর ক্যাম্পের বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ২০১৭ সালে তারা যখন বাংলাদেশে আসে তখন আলইয়াকিন বাহিনীর অস্তিত্ব থাকলেও অতটা তৎপর ছিল না তারা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এখন তারা সুসংগঠিত। প্রতিটি ক্যাম্পের পাশে নির্জন এলাকা কিংবা পাহাড়ের চূড়ায় আস্তানা তৈরি হয়েছে তাদের। মূলত ১৬-৩০ বছর বয়সী যুবকদের প্রশিক্ষণের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে। এক মাসের বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ শেষে তাকে আবার ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বর্তমানে প্রতি ক্যাম্পেই কমপক্ষে ২৫ জন আলইয়াকিন সদস্য অবস্থান করছে। দিনের বেলায় নীরব থাকলেও রাতের বেলায় শুরু হয় এদের কার্যক্রম।
সূত্র জানায়, আলইয়াকিনের নেতৃত্বে ৩ জন রোহিঙ্গা রয়েছে। কিন্তু তারা কখনো জনসম্মুখে আসে না। প্রতি ৩ মাস পর পর এ নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে। ফলে কখন কার ইন্ধনে সংগঠন পরিচালিত হচ্ছে সেটা বোঝা বড় কঠিন। আলইয়াকিনের বাহিনীর সশস্ত্র উপস্থিতির কথা স্বীকার করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্ব পালন করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুজন সদস্য বলেন, ক্যাম্প অভ্যন্তরে অস্ত্রের মহড়া নতুন কিছু নয়। সন্ধ্যার পরে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায় আলইয়াকিনের সদস্যরা। তারা এতই ভয়ানক যে কেউ তাদের কোনো কাজে বাধা দেয়ার সাহস পায় না।
এ বিষয়ে কক্সবাজারের উখিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নিহাদ আদনান তাইয়ান বলেন, আলইয়াকিন কিংবা এ ধরনের কোনো সুসংগঠিত গ্রুপ বাংলাদেশে নেই। রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটি অপকর্মকারী গ্রুপ এ ধরনের কাজ করছে। পরে ওই গ্রুপের সদস্যরাই এগুলো আলইয়াকিনের কাজ বলে গুজব ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরো বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো তথ্য পায়নি। যদি সত্যিই এ জাতীয় কোনো গ্রুপ থেকে থাকে, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই অভিযান পরিচালনা করা হবে। তবে উখিয়া থানার ওসি আবুল মনসুর আলইয়াকিনের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আলইয়াকিন নামে একটি গ্রুপ সক্রিয় আছে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াতেও তারা প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেছে বলে শুনেছি। ইতোমধ্যে আলইয়াকিনের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতেও পাঠানো হয়েছে। তারা যাতে সক্রিয় হতে না পারে এজন্য সব ধরনের গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত আছে।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button