স্বাস্থ্য

ঢামেক হাসপাতাল করোনার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বদ্ধপরিকরঃব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. এ কে এম নাসির উদ্দিন

সুমন রহমান: দিন যতই এগিয়ে যাচ্ছে করোনা রোগীর সংখ্যাও প্রতিদিন বাড়ছে। বিশ্বব্যাপী এর চিত্র প্রতিনিয়ত আমরা দেখতে পাচ্ছি। বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের করাল গ্রাসে প্রতিদিন যোগ হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। এ সংখ্যা আজ পঞ্চাশ লাখ ছাড়িয়েছে, মৃত্যুর সংখ্যাও তিন লাখ অতিক্রম করেছে। বিশ্ব পরিস্থিতির সাথে সাথে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন যেমন বাড়ছে তেমনি মৃত্যুর সংখ্যাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এর মধ্যে কোভিড ছড়িয়ে পড়েছে দেশের প্রায় সবকটি জেলাতে। গত ২৪ ঘন্টায় ১,৭৭৩ জন করোনায় আক্রান্ত সনাক্ত হযেছে, মৃত্যু হয়েছে ২২ জনের এবং সর্বমোট মৃত্যুর সংখ্যা ৪০৮  জন, আক্রান্তের সংখ্যা ২৭,৭৩৮ জন। রাজধানীতে করোনা রোগীদের জন্য ১০টি হাসপাতাল সরকার নির্ধারণ করেছিল। এর মধ্যে ৩টি বেসরকারী হাসপাতাল। দেশের সর্ববৃহৎ হাসপাতাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। জাতীয় যে কোন দুর্যোগময় মুহূর্তে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল রোগীদের সেবায় এগিয়ে এসেছে এবং অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছে। এই মহামারির সময়েও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল তাদের সেবার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে করোনা রোগীদের জন্য। আমরা জানি বৃহৎ এই হাসপাতালটিতে ২৬০০ শয্যা রয়েছে এবং এর বিপরীতে বিভিন্ন বিভাগে ভর্তি থাকে চার/সাড়ে চার হাজারের মত রোগী। বর্হিবিভাগে প্রতিদিন চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করেন তিন থেকে চার হাজার মানুষ। জরুরী বিভাগ সারা বছর খোলা থাকে এবং ২৪ ঘণ্টা সেবা প্রদান করা হয়ে থাকে। সারা দেশের জটিল রোগীদের একটি বড় অংশ এই বৃহৎ হাসপাতালটিতে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করে থাকেন। সাধারণ রোগের চিকিৎসার পাশাপাশি অনেক বিশেষ চিকিৎসাও বিনামূল্যে দরিদ্র রোগীদের দেয়া হয়। এক কথায় সাধারণ দরিদ্র রোগীদের নির্ভরযোগ্য ও ভরসা কেন্দ্র এই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ।

এই বৃহৎ পরিসরে এসব রোগীদের চিকিৎসা প্রদানের মাঝে করোনা চিকিৎসা প্রদানের সিদ্ধান্ত নি:সন্দেহে একটি চ্যালেঞ্জ ও মহৎ উদ্দেশ্য। কিন্তু কভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতাল ঘোষণার প্রেক্ষিতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের স্বাভাবিক অর্থাৎ দৈনন্দিন রোগীদের চিকিৎসা প্রদান ব্যাহত হচ্ছে কিনা, আদৌ তাদের চিকিৎসা সেবা দেয়া সম্ভভ হচ্ছে কিনা, করোনা রোগীদের সেবার ক্ষেত্রে কতটা সম্ভব এসব বিষয়ে জানতে আমরা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. এ কে এম নাসির উদ্দিন এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন যদিও সরকারী সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে আমাদের কভিড-১৯ রোগীদের সেবা প্রদান শুরু করতে কিছু দেরী হলেও আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নানারকম অপ্রতুলতার মধ্যেও করোনা রোগীদের সেবা প্রদানের প্রস্তুতি নিয়েছি এবং চিকিৎসা প্রদান করছি। আমরা যেহেতু সকল দুর্যোগে চিকিৎসার সেবায় নিয়োজিত থেকেছি, তাই এই দুর্যোগ মুহূর্তেও আমরা সেবার ব্রত নিয়ে করোনা রোগীদের পাশে দাঁড়িয়েছি। আমরা মনে করি, চিকিৎসক হিসেবে এটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এতে অনেক ঝুঁকি আছে। তারপরও এ চ্যালেঞ্জ আমরা সানন্দে গ্রহণ করেছি। আমাদের অন্যান্য দৈনন্দিন সেবা এবং জরুরী সেবা আগের মতই অব্যাহত আছে। পুরুনো ভবনে অন্যান্য সাধারণ চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে এবং ইউনিট-২ এবং বার্ণ ইউনিটে কেবলমাত্র করোনা রোগীদের চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে। বার্ন ইউনিটের রোগীদের ইতিমধ্যে শেখ হাসিনা বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারী ইন্সটিটিউটের নতুন ভবনে স্থানান্তর করা হয়েছে। ১ হাজার ৭০০ শয্যাবিশিষ্ট পূরনো ভবনে সাধারণ অর্থাৎ নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসা সেবা চলমান আছে। বার্ন ইউনিটে ৩০০ শয্যা এবং হাসপাতালে ইউনিট-২-তে ৬০০ শয্যা করোনা রোগীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে এবং চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালকে কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতাল ঘোষণার বড় কারণ হল করোনা আক্রান্ত রোগীদের অনেকেই অন্যান্য রোগেরও রোগী আছেন যাদের করোনার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য রোগের চিকিৎসা প্রদান একান্ত প্রয়োজন যা অন্যান্য হাসপাতালে দেয়া সম্ভব নয়। আবার অনেক হাসপাতালে সবরকম ব্যবস্থাও নেই। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সব রকম রোগের চিকিৎসা সেবা প্রদান সম্ভব এবং এখানে প্রায় সব ডিপাটমেন্টের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণও রয়েছেন। তাই করোনা আক্রান্ত রোগীদের করোনার পাশাপাশি অন্যান্য রোগের কম্বাইন্ড চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে আমরা সক্ষম। যদিও আমাদের লোকবল চিকিৎসক, নার্স, টেকনিসিয়ান প্রয়োজনের অনুপাতে অপ্রতুল। তবে আশার আলো সরকার ইতিমধ্যে ২ হাজার নবীন ডাক্তার ও ৪ হাজার নার্স নিয়োগ দিয়েছেন এবং ৫ হাজার টেকনিসিয়ান নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এতে সমস্যা অনেকটা লাঘব হবে।

এই কভিডের বিরাজমান পরিস্থিতিতে যারা আক্রান্ত হয়েছে, যারা সন্দেহজনক এবং যারা আক্রান্ত হয়নি এই তিনটি গ্রুপের মানুষের চিকিৎসা একসাথে একই হাসপাতালে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থাপনায় চলিয়ে যাওয়া ও সেবার মান নিশ্চিত করা অত্যন্ত দুরহ কাজ; বিশেষ করে এই প্রাণঘাতী করোনা রোগের ক্ষেত্রে। এটা অনেক বড় যুদ্ধ। আমরা চিকিৎসক কর্মচারী যারা আছি এই ঝুঁকিকে মেনে নিয়েই দায়িত্ব পালন করছি। কোভিড-১৯ মোকাবিলার নেতৃত্ব দেয়ার মনোভাব নিয়ে আমরা চিকিৎসা সেবা প্রদান করে যাচ্ছি। আমাদের এই মনোবল ও সাহস সঞ্চার করেছে মানুষের প্রতি ভালবাসা, দায়িত্ব এবং চিকিৎসক হিসেবে আমাদের সেবা প্রদানের প্রতিশ্রুতি ও প্রতিজ্ঞবন্ধতা। আমরা অনেক প্রতিকুল পরিস্থিতির মোকাবিলা করছি এবং তা কাটিয়ে একটু একটু করে পরিস্থিতির উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সেই সাথে অনেক নতুন নতুন জিনিসও আমরা শিখছি। অনেক ভুল ত্রুটিকেও প্রতিনিয়ত সংশোধন করছি।

নেফ্রোলজি বিভাগে ডায়ালিস রোগীদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন-এই বিভাগে ১৩০ জন সিডিউল রোগীকে সপ্তাহে ২দিন করে ডায়ালাইসিস প্রদান করা হতো হাসপাতাল-২ ভবনের ৪র্থ তলায় ডায়ালাইসিস সেন্টারে। কোভিড রোগীদের ভর্তির কারণে নেফ্রোলজি বিভাগের এই ১৩০ জন রোগীকে ডায়ালাইসিস সেবা প্রদান আমাদের পক্ষে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাদের ব্যাপারে আমরা খুবই সচেতন, কারণ একদিন ডায়ালাইসিস করাতে না পারলে এই রোগীদের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। আমরা আমাদের এই দায়িত্ব এড়িয়ে যাইনি। আমরা তিনটি বেসরকারী হাসপাতাল পপুলার, বিআরবি, সোনার বাংলা এবং একটি সরকারী হাসপাতাল সরোওয়ার্দী হাসপাতাল এর সঙ্গে যোগাযোগ করে ১৩০ জন রোগীকে ভাগ করে রেফার করে পঠিয়েছি এবং তারা সেখানে ডায়ালাইসিস সেবা গ্রহণ করছেন।

বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার বিষয়ে তিনি বলেন-তাদের সুরক্ষার বিষয়টি আমরা দুইভাবে দেখি। যেহেতু এখানে দু’টো কোভিড হাসপাতাল হয়েছে। একটা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারী। এখানে সার্জিক্যাল ডিভিশন, শিশু ও গাইনী বিভাগ রয়েছে। অপরটি মেডিক্যাল ডিভিশন যা হাসপাতাল-২ এ। এখানে মেডিসিন, হৃদরোগ, ক্যান্সার, কিডনী ও অন্যান্য বিভাগ, কোভিড ও সন্দেহজনক কভিড রোগীর সেবা প্রদান করা হচ্ছে। সন্দেহজনক কভিড রোগীদের জন্য ২টি ফ্লোর, কোভিড রোগীর জন্য ২টি ফ্লোর রয়েছে। যার মাঝখানের পুরনো ভবনে নন-কোভিড, সার্জারী, আইসিইউ, এনআইসিসিইউ, ওটি, শিশু বিভাগ চলমান আছে। বহির্বিভাগ ও জরুরী বিভাগ যথারীতি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সংক্রমন প্রতিরোধের জন্য নতুন ও পুরনো ভবনে যাতায়াতের রাস্তা বন্ধ করে দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, করোনার চিকিৎসা প্রদান করতে গিয়ে ইতিমধ্যে ৩০জন চিকিৎসক, ৮০ জন নার্স ২০ জন কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এদের বেশীর ভাগই আল্লাহর রহমতে সুস্থ হয়ে কাজে যোগদান করেছেন এবং কেউ কেউ হোমকোয়ারেনটাইনে আছেন। আশা করি তারাও কিছুদিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে কাজে যোগ দিবেন। করোনা চিকিৎসায় প্লাজমা খেরাপী একটি নতুন আশার আলো সঞ্চয় করেছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিচালক মহোদয় বলেন-প্লাজমা থেরাপি একটি নতুন কনসেপশন। আমরা জানি যে রোগী করোনাতে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়েছে তার প্লাজমাতে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধী এন্টিবডি তৈরি হয়েছে এবং এই এন্টিবডি প্লাজমায় থেকে যায়। যদি একজন করোনা আক্রান্ত রোগীকে এই এন্টিবডিযুক্ত প্লাজমা প্রদান করা যায় তবে তা করোনার জীবণু ধ্বংস করে তাকে সুস্থ করে তুলতে পারে। এ ধারণার বশবর্তী হয়ে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশ এ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত পূর্ণ সফলতা আসেনি। ধারণা করা হয় বিভিন্ন রোগ যেমন ডিপথেরিয়া বা টিটেনাস এর ক্ষেত্রে ভাইরাসগুলো মারা যায়। সেই ধারণা থেকেই আমরা এটা করার চেষ্টা করছি। এখন এর উপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমরা কোন মুমূর্ষু রোগীকে ঐ রোগী ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে এটা প্রয়োগ করব। সেই সাথে অন্য একটি গ্রুপকেও এটি প্রয়োগ করে দেখব রোগীর দ্রুত আরোগ্যলাভ হচ্ছে কিনা, জটিলতা কমছে কিনা বা সে বেঁচে গেল কিনা। এর বিভিন্ন ফলাফল আসতে পারে। একটি গ্রুপে বেশী কার্যকর আবার অন্য গ্রুপে নাও হতে পারে। যদি আমাদের জন্য লাভজনক হয় অর্থাৎ ফলাফল ভাল হয় এবং প্লাজমা খেরাপী দিলে রোগী দ্রুত সেরে উঠছে এবং ভাল হয়ে যাচ্ছে তখন আমরা এটি নিয়ে কাজ করব। তবে এখন তা সম্পূর্ণ পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে।

কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত বেশ ক’টি হাসপাতালের বিরুদ্ধে রোগী ভর্তি না করে বা রোগীদেও হয়রানী করার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ সংবাদ মাধ্যমে অহরহ প্রকাশিত হচ্ছে সেই ব্যাপারে দৃষ্টি আর্কষণ করলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসির উদ্দিন বলেন- এসব ঘটে থাকলে এটা অত্যন্ত দু:খজনক। কিন্তু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল হতে বিনা চিকিৎসায় কোন কোভিড-১৯ রোগীকে ফেরত দেয়ার কোন নজির নেই তবে অনেক ক্ষেত্রে সুচিকিৎসার স্বার্থে আমরা কোন কোন রোগীকে অন্য হাসপাতালে রেফার করে থাকি।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Back to top button