জাতীয়রাজনীতিলিড নিউজ

জাতীয় কাউন্সিল চলতি বছরই: মির্জা ফখরুল

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সবকিছু ঠিক থাকলে এ বছরই দলের সপ্তম জাতীয় কাউন্সিল করতে চাই। এ লক্ষ্যে আমাদের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। তবে দিনক্ষণ এখনই চূড়ান্তভাবে বলা যাবে না।

কারণ সবকিছু আমাদের ওপর নির্ভর করে না। পরিস্থিতি, পারিপার্শ্বিকতার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর যখন মনে করব উপযুক্ত সময় এসেছে, তখন কাউন্সিল করে ফেলব।

শুক্রবার সকালে উত্তরায় নিজ বাসভবনে  সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব এসব কথা বলেন। এ সময় দল পুনর্গঠন, চেয়ারপারসনের মুক্তি, রোহিঙ্গা সংকট, সরকারের নানা ব্যর্থতাসহ দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে খোলামেলা আলাপ করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে বিএনপির প্রধান চ্যালেঞ্জ দুটি। প্রথমত, দলকে গোছানো আর দ্বিতীয়ত, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, সরকারের ব্যর্থতাকে সামনে রেখে অবিলম্বে বৃহত্তর মুভমেন্টে যাওয়া হবে- এ লক্ষ্যে আমরা বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে চাই। সেই প্রক্রিয়া শুরু করেছি। জোট ও ফ্রন্ট- এ দুই ক্ষেত্রেই পরিধি বাড়ানোর কথা জানিয়ে তিনি বলেন, জোটের রাজনীতিতে কেউ যাবে, কেউ আসবে এটাই রাজনীতি।

বর্তমান সরকারের কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নির্বাচনের পর সরকার তাদের বৈধতার যে অভাব, সেটা পূরণ করতে বিভিন্ন কৌশল নিচ্ছে। বর্তমান সরকারের নৈতিকভাবে কোনো ভিত্তি নেই, কারণ তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হননি। তাই জনগণের প্রতি তাদের কোনো দায়বদ্ধতাও নেই। দেশে এখন সত্যিকার অর্থে কোনো গণতন্ত্র নেই। দু-একটি ফ্লাইওভার দেখিয়ে তারা উন্নয়নের কথা বলছে।

কিন্তু উন্নয়ন মানেই তো গণতন্ত্র নয়। উন্নয়নের আড়ালে চলছে লুটপাট। ক্ষমতাসীন দলের কিছু লোক আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেন। সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোনো উন্নয়ন হয়নি।

ফখরুল বলেন, দেশে কোনো আইনের শাসন নেই। নেই কোনো জবাবদিহিতা। শেয়ারবাজার, ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে যাচ্ছে কিন্তু সরকারের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি। দ্রব্যমূল্য লাগামহীন, সড়কে দুর্ঘটনায় প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, খুন, গুম, ধর্ষণ বেড়েই চলেছে। ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবেলায় তারা ব্যর্থ। দেশে কোনো বিনিয়োগ না থাকায় অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। সবমিলে নির্বাচনের পর রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ।

মির্জা ফখরুল বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের সামনে মূলত দুটি চ্যালেঞ্জ। প্রথমত, দলকে গোছানো আর দ্বিতীয়ত, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি। আমরা চাই, আইনি প্রক্রিয়ায় চেয়ারপারসনের মুক্তি। কিন্তু বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার যে অবস্থা তাতে শুধু আইনের ওপর নির্ভর করে থাকার কোনো কারণ নেই। আমরা রাজনৈতিকভাবেও তার মুক্তির জন্য কাজ করছি। এজন্য প্রয়োজন আন্দোলন। চেয়ারপারসনের মুক্তির জন্য আমরা আন্দোলনে আছি। এটাকে আরও বেগবান করা হবে।

তিনি বলেন, আমরা যে কোনো উপায়ে চেয়ারপারসনের মুক্তি চাই না। চাইলে আগেই বলে দিতে পারতাম। আমরা চাই জামিনে তার মুক্তি হোক। এটা তার প্রাপ্য। কারণ জামিন না পাওয়ার কোনো কারণ নেই। এ ধরনের মামলায় সবাই জামিন পেয়েছেন। জামিন না দেয়া মানে সরকার প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তাকে জোর করে কারাগারে আটকিয়ে রাখতে চায়। ফখরুল বলেন, আমরা কখনও বলিনি চেয়ারপারসনকে প্যারোলে মুক্তি দেয়া হোক। দল বা তার পরিবারের পক্ষ থেকেও এমনটা বলা হয়নি। আইনি প্রক্রিয়ায় তাকে মুক্তি দিয়েই উন্নত চিকিৎসার সুযোগ দিতে হবে।

দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশের বাইরে- এমন পরিস্থিতিতে দল পরিচালনায় কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, দলীয় কর্মকাণ্ড ও সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তারা সরাসরি আমাদের সঙ্গে না থাকলেও তাদের নির্দেশনা মতো কাজ করে যাচ্ছি। যৌথ নেতৃত্বের মাধ্যমেই আমরা দল চালাচ্ছি। অতীতের চেয়ে দল আরও ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী হয়েছে। তবে শীর্ষ নেতৃত্বের অনুপস্থিতি কিছু কিছু ক্ষেত্রে একটু সমস্যা হবে- এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের ভাঙন এবং এর ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে এসব জোট ও ফ্রন্ট গঠিত হয়ে থাকে। নির্বাচনের পর স্বাভাবিকভাবে তা একটু দুর্বল হয়ে যায়। রাজনীতিতে কেউ চলে যেতে পারে। কেউ যাবে কেউ আসবে- এটাই রাজনীতি। এমনও সময় আসতে পারে- আজ যারা চলে গেছেন, তারা আবার আসবেন।

তিনি বলেন, রাজনীতিতে এখন মূল ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার। এজন্য সংগ্রামের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য প্রয়োজন বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য। এ ক্ষেত্রে আমরা জোট ও ফ্রন্ট দুটোকেই রাখতে চাই, এমনকি তারা আছেও। এটাকে আরও বাড়ানো দরকার। আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলছি। আমরা চাই একটা জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হোক। কোনো দলকে আমরা আলাদা করে ভাবছি না। রাজনীতিতে সুস্থ ধারা আনতে হলে আওয়ামী লীগের অপশাসনের বিরুদ্ধে সব রাজনৈতিক দলকে একসঙ্গে সোচ্চার হতে হবে।

একদিকে বলছেন সরকারের বৈধতা নেই, অন্যদিকে তাদের অধীনেই নির্বাচনে যাচ্ছেন, এটা দ্বৈতনীতি কিনা- জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। আমাদের সব সময় নির্বাচনের মধ্যেই থাকতে হয়। নির্বাচনের বাইরে গেলে বিএনপি কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই জনগণের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। নির্বাচনে থাকলে জনগণের কাছে পৌঁছার সুযোগ সৃষ্টি হয়। বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক কোনো স্পেস নেই।

তাই আমরা চেষ্টা করছি যতটুকু সুযোগ পাওয়া যায়, তার পুরোপুরি কাজে লাগাতে। দলের পুনর্গঠন প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা বিরোধী দলে আছি। চাইলেই সবকিছু সময়মতো করতে পারি না। নেতাকর্মীদের ওপর সরকারের দমন-পীড়ন, হামলা-মামলা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সরকারের নানা বাধার পরও দলকে অনেকটা গুছিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। আশা করি দ্রুতই সব জেলার সম্মেলন শেষ করে নতুন কমিটি ঘোষণা করা সম্ভব হবে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি জেলার নতুন কমিটি দেয়া হয়েছে। অঙ্গসংগঠনগুলোও পুনর্গঠন হচ্ছে।

তিনি বলেন, পুনর্গঠনকে আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। সব ক্ষেত্রেই এবার কাউন্সিলরদের ভোটে নেতা নির্বাচন করা হবে। এর মধ্য দিয়ে যোগ্য ও ত্যাগীরাই শীর্ষ নেতৃত্বে আসার সুযোগ পাবেন।

ভবিষ্যৎ আন্দোলন প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারের ব্যর্থতা এবং নতুন নির্বাচনের দাবিতে আমরা বৃহত্তর মুভমেন্টে যাব। অবিলম্বে নির্বাচনের দাবিতে আমরা এখনও আন্দোলনে আছি। মুভমেন্ট বলতে তো শুধু হরতাল বা অবরোধকেই বোঝায় না। মুভমেন্ট বলতে বোঝায় জনগণের মধ্যে একটা আন্দোলন সৃষ্টি করা। আমরা সেই কাজটিই করছি। ইতিমধ্যে আমরা কয়েকটি বিভাগে সমাবেশ করেছি। সামনে আরও কয়েকটি সমাবেশ করব। ছোটখাটো মিছিল হচ্ছে। ঢাকায়ও সমাবেশ হবে। যতটুকু স্পেস পাচ্ছি তা কাজে লাগাচ্ছি। বলতে পারেন, বৃহত্তর আন্দোলনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দিনক্ষণ চূড়ান্ত করে আন্দোলনে নামা সম্ভব নয়। রাজনীতিতে এটা বলা সম্ভব নয়।

আন্দোলন অনেকাংশে নির্ভর করে পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা কাজ করছে। এখন সবাইকে আবার জাগিয়ে তুলতে হবে। এতে কিছুটা সময় লাগছে। মানুষকে রাস্তায় নামানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ঠাণ্ডা মাথায় সামনের দিকে এগোতে হবে। তা না করা গেলে ইতিবাচক ফল আসবে না।

নির্বাচনের আগে ও পরে ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের ভূমিকা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন- এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব বলেন, তার ভূমিকা নিয়ে আমাদের বিন্দুমাত্র প্রশ্ন নেই। বৃহত্তর ঐক্যের ক্ষেত্রে তিনি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে ড. কামাল হোসেনকে বিএনপি সামনের দিকে আনার চেষ্টা করেছে।

দলের কেউ যদি তার ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ করেন সেটা তার ব্যক্তিগত মতামত। এটা দলের সিদ্ধান্ত নয়। বরং যারা কামাল হোসেনের সমালোচনা করছেন তারা ঐক্য চায় কিনা, আমার সন্দেহ। রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় করণীয় প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা শুরু থেকেই সরকারকে বলে আসছিলাম, এটাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে। এ সংকট মোকাবেলায় জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার কথাও বলেছিলাম। কিন্তু সরকার সেটাকে গুরুত্ব দেয়নি। আমরা আবারও বলছি, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় সরকারকে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। সরকারের আরও শক্তি বাড়ানো উচিত। রোহিঙ্গাদের মূল দাবি নিয়ে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর কাছে যেতে হবে। কিন্তু সরকার মূল সমস্যাটা সমাধানের দিকে যাচ্ছে না। রোহিঙ্গা ইস্যুটা দ্রুত সমাধান করা না গেলে শুধু ওই অঞ্চল নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়াতে এটা একটা বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেবে। তাই বিষয়টিকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button