সম্পাদকীয়

কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন – অবস্থা খুবই জটিল !

প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি ঘরের কথা বাইরে বলার জন্যে,  কানাডার গোপনীয় কথা বাংলাদেশে জানিয়ে দেয়ার জন্য।

কিন্তু কি আর করা- কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন নিয়ে প্রতারণা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে অনেক দিন পর আবারো এই বিষয়টি নিয়ে লিখতে বসলাম।  কোনো ব্যাক্তি বিশেষ কে কষ্ট দেয়া আমার উদ্দেশ্য নয়, কারো নাম আমি উল্লেখ করি নি, কোনো প্রতিষ্ঠানের নামও আমি বলি নি ,  বরং সার্বিক অবস্থার একটু খন্ড চিত্র  তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।  কেউ লেখাটি পড়ে    মনে কষ্ট নিবেন না, বা আমাকে ভুল বুঝবেন না আশা করি।

কানাডিয়ান জব অফারের নামে  যে প্রতারণা অনেকদিন ধরে চলে আসছিলো তা বহুগুন বেড়ে গেছে সম্প্রতি বিডিং বা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কানাডার পাঁচটি প্রভিন্সের এগারোটি কমিউনিটি রুরাল এন্ড নর্থার্ন কমিউনিটি প্রোগ্রামের আওতায় নির্বাচিত হওয়ার পর। আটলান্টিক ইমিগ্রেশন পাইলট প্রোগ্রামের মাধ্যমে আটলান্টিক  তীরের চারটি প্রভিন্স খুব সফলতার সঙ্গে বিগত কয়েক বছর ধরে ঐসব কম জনবহুল  এবং অল্প পরিচিত  প্রভিন্সগুলোতে অভিবাসী আনতে এবং ধরে রাখতে সক্ষম হচ্ছে।   আর তাই এই প্রকল্পেরই আদলে  সম্প্রতি ফেডারেল গভঃমেন্ট  কানাডার পাঁচটি প্রভিন্স – আলবার্টা, ব্রিটিশকলাম্বিয়া, মানিটোবা, অন্টারিও এবং সাস্কাচুয়ান এর ১১ টি  ছোট এবং গ্রামীণ কমিউনিটি নির্বাচন করেছে। এইসব কমিউনিটিতে লোকসংখ্যা মাত্র ৫০,০০০ থেকে ২০০,০০০ এর মধ্যে, এদের আয়তন অনেক বড়ো   এবং এগুলো  প্রভিন্সিয়াল বড়ো বড়ো  সিটি থেকে কমপক্ষে ৭৫  কিলোমিটার দূরে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরো অনেক  অনেক দূরে। এই প্রকল্পের জন্যে সবেমাত্র কমুনিটিগুলো বাছাই করা হয়েছে, কিভাবে প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে, কবে হবে, কাদের মাধ্যমে হবে  তার কোনো রূপরেখা এখনো ঠিক করা হয় নি।  অথচ প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে গেছে – বাংলাদেশ থেকে  এই প্রকল্পের নামে কোনো আইএল্টস বা ফ্রেঞ্চ স্কিল ছাড়া, কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়া, কোনো কাজের অভিজ্ঞতা ছাড়া শুধু মানুষ চাইছে এইসব কমিউনিটি গুলো।ওরা বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশ চেনে না, ওরা তাই মরিয়া হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ থেকেই জব অফার দিয়ে লোক আনার জন্য। কি হাস্যকর কথাবার্তা।

বিজনেস অন্ট্রেপ্রেনার ক্যাটাগরিতে মানিটোবার ব্রান্ডনে আমার একজন ক্লায়েন্ট একটি পুরানো গ্যাস স্টেশন কিনে সম্পূর্ণ আধুনিকায়ন করে, কনভেনিয়েন্স স্টোর এবং কফিশপ চালু  করে বাংলাদেশ থেকে  খুব শিগগির আসবেন।  আর এইজন্য ব্র্যান্ডন কমুনিটির বিসনেস ব্রোকার, ডেভেলপার, সেটেলমেন্ট অর্গানাইজেশন  এর সঙ্গে  দীর্ঘ দিন থেকে আমার হর হামেশাই কথা বলতে হয়।  গতকাল  ব্র্যান্ডন থেকে কার্লি  আমাকে ফোন  করেছিল। ও জিজ্ঞেস করলো- তুমি তো অরিজিনালি বাংলাদেশের,  তাই না? আমার কলিগ ন্যান্সি ডুবে ব্রান্ডনের হোমলেসনেস রিমুভাল প্রজেক্টে কাজ করে- ও বাংলাদেশ থেকে হাজারে হাজারে ইমেইল পাচ্ছে- ওর কাছে কোনো জব অফার আছে কিনা, জব অফার থাকলে ওরা ব্রান্ডনে আসতে পারবে।    তুমি কি এব্যাপারে কিছু জানো ? এগুলো কি স্প্যাম নাকি? ইমেইল এডড্রেসটা হলো [email protected] । ইমেইল এড্রেস দেখেই বোঝা যায় এটি অবশ্যই ব্রান্ডনের  কোনো একজন সোশ্যাল ওয়ার্কার এর যে কিনা হোমলেসনেসদের নিয়ে কাজ করে।  তাহলে এই ইমেইল এড্রেস বাংলাদেশে গেলো কি করে? আমি ভীষণ বিস্ময় প্রকাশ করলাম   আর বললাম হয়তো স্প্যাম ;আসল ঘটনা-  বুঝে চেপে গেলাম।    বেশ কয়েক দিন আগে বিসিসিবি বা বাংলাদেশী কানাডিয়ান কানাডিয়ান বাংলাদেশীদের একটি ফেইসবুক পেজ এ  একটা লেখা পড়েছিলাম- কিভাবে রুরাল এন্ড নর্থার্ন ইমিগ্রেশন পাইলট প্রোগ্রামের মাধ্যমে জব অফার পাওয়া যায়।  লেখক নিজে লেখেন নি কালেক্টেড হিসাবে ছেপেছেন। লেখকের উদ্দেশ্য কোনোভাবেই খারাপ নয়, তিনি বাংলাদেশী ভাইবোনদের কানাডিয়ান  জব অফার পাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করতে চেয়েছেন।  ওই লেখায়  পাঁচটি প্রভিন্সের ১১টি কমুনিটির  অনেকগুলো  ফোন নম্বর, ইমেইল এড্রেস এবং কমিউনিটি অর্গানাইজেশন  এর নাম ছিল, তার মধ্যে ব্র্যান্ডনের ন্যান্সি ডুবের এই  ইমেইল এড্ড্রেসও  ছিল, এবং আমারও একই কথা  মনে হয়েছিল- হোমলেসনেস প্রজেক্টের ইমেইল এড্ড্রেসে কিভাবে জব অফার পাওয়া যাবে? বাকি ইমেইল এড্রেস এবং কমিউনিটি  অর্গানাইজেশন  গুলোও অধিকাংশই সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট, কমিউনিটি প্ল্যানিং, আদিবাসীদের উন্নয়ন প্রকল্প এগুলোই ছিল।

এবার আসি মূল কথায়। কানাডার ইমিগ্রেশন নিয়ে প্রতারণার জন্যে আমরা সব সময় শুধু বাংলাদেশে বসে যারা ভিসা এবং ইমিগ্রেশন এপ্লিকেশন করে থাকেন তাদেরকেই দোষারোপ করি।  কিন্তু আপনারা জানেনকি  তাদের চেয়ে বড়, অভিজ্ঞ এবং ধুরন্ধর  লোক খোদ কানাডাতেই থাকেন ? অনেক উদাহরণের মধ্যে আজ শুধু কুইবেকের ইনভেস্টর এপ্লিকেশন, স্টুডেন্ট ভিসা এপ্লিকেশন এবং জব অফারের উদাহরণ দেব।

কুইবেকের ইনভেস্টর আপ্পলিকেশনের জন্য আমাদের অনেক বিখ্যাত কানাডিয়ান আছেন যারা এখানকার লাইসেন্সড ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট বা লইয়ার তো দূরেই থাকুক, এজেন্ট ও না। তারা বাংলাদেশের ইনভেস্টরদের বলেন, আমার কোনো স্বার্থ নেই, আমাকে কোনো টাকা পয়সা দিতে হবে না , আমি শুধু আপনাদের ইমিগ্রেশন চাই কারণ আপনারা দেশি মানুষ। আপনারা সরাসরি কুইবেকের  লইয়ার এর সাথে কথা বলে ইন্সুরেন্সের টাকা, এপ্লিকেশন ফী সবই তাদেরকেই দেবেন, আমি কোনো টাকা পয়সার লেনদেন করি না।  আর আমাদের ইনভেস্টররা  তাই বিশ্বাস করেন। অথচ যে  কমিশন উনারা   লইয়ার  এবং ইনভেস্টর /ইন্সুরেন্স  কোম্পানির   কাছ থেকে   পান তার পরিমান না হয় নাই বা বললাম।  শুধু তাই নয়, এইসব ইনভেস্টররা যখন কানাডায় এসে উনাদের ঠিক করা রিয়েল এস্টেট এজেন্টদের কাছ থেকে  বাড়ি কেনেন তখনও তারা বড়ো অংকের রেফারাল পান।

স্টুডেন্ট ভিসার জন্য আমাদের কানাডিয়ান-বাংলাদেশীরাই যারা এখানকার লাইসেন্সড ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট/স্টুডেন্ট কনসালটেন্ট  বা লইয়ার তো দূরেই থাকুক, এজেন্ট ও না তারা বিজ্ঞাপন দেন, সুদীর্ঘ ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা এবং সরাসরি কানাডা থেকে পরিচালিত – কোনো আইএল্টস ছাড়াই কানাডার ———— বিশ্ববিদ্দালয়ে, —————– কলেজে আসার সূবর্ণ সুযোগ।  অথচ এইসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্দালয় বা কলেজে বিপুল অংকের টুইসন ফী দিয়ে পড়া শেষে ওয়ার্ক পারমিটও  তাদেরকে দেয়া হয় না আর ইমিগ্রেশন এপ্লিকেশন করা তো দূরেই থাকুক।  এরা এইসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ার পর দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হয়, কারণ  সরকারি  বিশ্ববিদ্দালয় বা কলেজ থেকে পাশ না করলে পোস্ট-গ্রাজুয়েট ওয়ার্ক পার্মিটও দেয়া হয়না আর ইমিগ্রেশনের আবেদনও করা যায় না- এটিই কানাডিয়ান ইমিগ্রেশনের বর্তমান নিয়ম  ।   কানাডার ভিতর থেকেই জব অফারের কথা বাংলাদেশে বলছে করা? বিভিন্ন প্রভিন্সএ ——————- গ্রোসারি, ——————— রেস্টুরেন্ট, ————ফার্ম ওয়ার্কার, ——————– কেবিনেট মেকার, ————– গ্যাস স্টেশন ওয়ার্কার, হিসাবে দুই একজনকে এনে বিশ্বস্ততা অর্জন করে, হাজার হাজার বাংলাদেশিদের কাছ থেকে ভুয়া জব অফার দেখিয়ে বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে আমাদের  কানাডার ভিতরেরই লোকজন। এরা প্রভিন্সিয়াল ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টেও ব্লাকলিস্টেড হয়ে গেছে।  স্কীলড ইমিগ্রেশনের জন্য বাংলাদেশের বহু আবেদন একেবারে শেষ মুহূর্তে বাতিল হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে ; কারণ তাদের রিপ্রেসেন্টেটিভে কানাডার লাইসেন্সপ্রাপ্ত নন।  কানাডার আইন অনুযায়ী ভিসা এবং ইমিগ্রেশনের জন্য যদি কেও সাহায্য করে তবে সেটি অবশ্যই  ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টকে নির্দিষ্ট ফর্মের মাধ্যমে জানাতে হবে।  এইসব কাজ অর্থের বিনিময়ে করতে হলে কানাডিয়ান লাইসেন্স প্রাপ্ত হতে হবে।  কানাডিয়ান লাইসেন্সপ্রাপ্ত ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট বা লইয়ার যদি  কানাডায় বা অন্য কোনো  দেশে কোনো এজেন্ট নিয়োগ করেন, তবে তাকে ঠিকমতো ট্রেনিং দিতে হবে  তার জন্যেও  ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টে থেকে লাইসেন্স নিতে হবে এবং এজেন্টের সমস্ত কর্মকান্ডের জন্য কানাডিয়ান লাইসেন্সধারী ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট বা লইয়ার দায়ী থাকবেন।    তাই আপনাদের কাছে অনুরোধ আপনার কানাডিয়ান  ভিসা এবং ইমিগ্রেশন এপ্লিকেশন করার জন্যে যদি কাউকে টাকা দিতে চান আগে তার লাইসেন্স নম্বর চান,  লাইসেন্স নম্বর নিয়ে আপনি অনলাইনে আইসিসিআরসি বা ল সোসাইটি অফ কানাডা থেকে   দেখে চেক করতে পারবেন- এটি সঠিক কিনা। যদি আসল লাইসেন্স না থাকে , তাকে বাই বাই বলুন।  সে যদি কারো এজেন্ট হয়ে থাকে তাহলে   ইমেইল বা ফোনের মাধ্যমে কানাডিয়ান লাইসেন্সপ্রাপ্ত কনসালটেন্ট বা লইয়ার এর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করুন , ওয়েবসাইটের মাধ্যমেও  যোগাযোগ করতে পারেন।

আসছে নভেম্বর এর শুরুতে  , গুলশান ক্লাবের পেটিও হলে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন এবং ভিসা নিয়ে একটি সেমিনারে উপস্থিত থাকবো আমার প্রিয় দেশি ভাইবোনদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য।  আশা করি উপস্থিত থাকবেন  অনেকেই ।

ধন্যবাদ সবাইকে আমার লেখা পড়ার জন্যে, ভালো থাকুন, ভালো রাখুন সবাইকে।   কেও রাগ করবেন না আমার উপর, কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে ক্ষমা করবেন,  অনিচ্ছাকৃতভাবে কষ্ট দেয়ার জন্য। আমরা সবাই বাংলাদেশের, তাই আমরা সবাই আপন  এটি আমি কখনো ভুলিনা।

মাহমুদা  নাসরিন  ,  আরসিআইসি & কমিশনার অফ ওৎস , ক্যানবাংলা ইমিগ্রেশন সার্ভিসেস, ২০৫/৩০৯৮ ডানফোর্থ এভিনিউ, শিক্ষক এবং সমাজকর্মী, প্রাক্তন সহযোগী অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্দালয় এবং কিং খালিদ বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব ।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button