রংপুর বিভাগসারাদেশ

অবৈধ বালু উত্তোলন পাউবো’র ১০ কোটি টাকা জলে যাওয়ার শংকা

রৌমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি: সরকারের মাঠ প্রশাসনকে দেয়া কঠোর নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও কোনো ভাবেই অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ হচ্ছে না কুড়িগ্রামের রৌমারী ও রাজীবপুরে। এ দু’উপজেলায় এক শ্রেণির বালু ব্যবসায়ি ব্রহ্মপুত্র ও সোনাভরি নদের তীর ঘেষে ড্রেজার মেশিনে দিনরাত অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলন করছে। এভাবে বালু উত্তোলনের ফলে ব্রহ্মপুত্র নদের ডানতীর জুড়ে অনেক এলাকা জনপদ স্থাপনা ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে। শুধু তাই নয় নদের ডানতীরে ভাঙ্গন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রায় ১০ কোটি টাকার চলমান প্রকল্প গুলোর লক্ষ ও উদ্দেশ্য ভেস্তে যাওয়ার আশংকা করা হচ্ছে। ভাঙ্গনের মুখে পড়া এলাকা গুলোর সাধারণ মানুষ দ্রুত অবৈধ ওই বালু উত্তোলন বন্ধের দাবি জানিয়েছে।
সরেজমিনে ব্রহ্মপুত্র নদের ডানতীর ঘুরে দেখা গেছে, দু’উপজেলায় প্রায় অর্ধশত ড্রেজার মেশিন বসিয়ে অবৈধ ভাবে বালু তুলছে বালু খেকোরা। রৌমারীর ঘুঘুমারী থেকে বলদমারা হয়ে ফুলুয়ারচর পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার এবং রাজীবপুর উপজেলার মদনেরচর থেকে নয়াচর পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার এলাকায় নদের তীর ঘেষে ৩০টির মতো ড্রেজার মেশিনে বালু তোলা হচ্ছে। যেসব স্থানে বালু তোলা হচ্ছে সেইসব স্থানেই ভাঙ্গনরোধে পাউবো’র ১০টি প্রকল্প ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে কাজ করা হচ্ছে। অবস্থাটা এমন ভাঙ্গনের মুখে ঠেলে দিয়ে সেই ভাঙ্গন রোধে অর্থ ঢালছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। অবৈধ বালু উত্তোলন আর পাউবো’র চলমান কাজ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন এলাকাবাসি।

রৌমারী উপজেলার বলদমারা ঘাট ও ফুলুয়ারচর এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলনের চিত্র দেখা গেছে। আবার সেই একই স্থানে পাউবো’র প্রকল্পের কাজও চলছে। সরকারি নিয়ম অনুসারে যে স্থানে পাউবো’র প্রকল্পের কাজ হবে সেখান থেকে কমপক্ষে দুই হাজার মিটারের মধ্যে কোনো ক্রমেই বালু উত্তোলন করা যাবে না। অথচ প্রকল্পের ৫০/১০০ মিটারের মধ্যেই অবাধে বালু তোলা হচ্ছে। একইভাবে পাওয়া গেছে রাজীবপুর উপজেলার মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের চরনেওয়াজী এলাকায়ও। ব্রহ্মপুত্র নদের পাউবো’র চলমান প্রকল্পের স্থান ঘেষে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তুলে ব্যবসায় নামছেন ওই এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন। এখানে চারটি গ্রুপের চারটি প্রকল্পের স্থানে ৬টি ড্রেজার মেশিন বসানো হয়েছে।
কুড়িগ্রাম পাউবো সূত্রে জানা গেছে, ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙ্গন রোধে রৌমারী ও রাজীবপুর উপজেলাকে রক্ষা করতে প্রায় ৪৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে দীর্ঘ মেয়াদি একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এতে রৌমারীর ঘুঘুমারী থেকে ফুলুয়ারচর ঘাট পর্যন্ত সাড়ে ৩ কিলোমিটার এবং রাজীবপুর সদরের মেম্বারপাড়া থেকে মোহনগঞ্জ বাজার পর্যন্ত ৩ হাজার ৮শ’ মিটার জুরে নদের তীরে সিসি ব্লক ও জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা হবে। চলতি বছরে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০টি গ্রুপের কাজ চলছে।
এদিকে পাউবো’র ভাঙ্গন রোধে সিসি ব্লক ডাম্পিং ও জিও ব্যাগ ফেলানোর কাজেও ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা। স্থানীয় বাসিন্দা হেলাল উদ্দিন, আব্দুর রফিক, রুবেল মিয়া অভিযোগ করেন, কাজের শুরু থেকে অনিয়ম আর ধোকাবাজির খেলা চলছে। জিও ব্যাগে বালু ভরাট করার নিয়ম থাকলেও এখানে জিও ব্যাগে ভরা হচ্ছে কাদামাটি। দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদার বিপ্লব চন্দ্র ব্যানারজি পাউবো’র প্রকৌশলীকে ম্যানেজ করেই তা করছে বলে জানান তারা। মোহনগঞ্জ ইউপি সদস্য আলম মিয়া বলেন, ‘পাউবো’র দায়িত্ব প্রাপ্ত ঠিকাদার প্রকাশ্যেই ওই অনিয়ম দুর্নীতি করছে কিন্তু প্রকৌশলীরা চুপ করে রয়েছেন। এ বিষয়ে মোবাইল ফোনে নির্বাহী প্রকৌশলীকে অবহিত করার পর তিনি উল্টা হুমকি দেন আমাকে। বলেন বার বার ফোন করলে প্রকল্প বাতিল করে দেয়া হবে।’

রাজীবপুরের চরনেওয়াজী গ্রামের বাসিন্দা সানোয়ার হোসেন তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘নদের যে স্থানে ভাঙ্গন প্রতিরোধে বালুর বস্তা ফেলা হবে সেই স্থান থেকেই ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উঠানো হচ্ছে। এর ফলে পাউবো’র গৃহীত প্রকল্পের লক্ষ ও উদ্দেশ্য ভেস্তে যাবে- এটা নিশ্চিত করে বলাই যায়। আমরা এলাকাবাসি অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধের দাবি জানিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছি। এ অবস্থায় ইউএনও একদিন এসে বালু উত্তোলন বন্ধ করে গেছেন। কিন্তু একদিন পর সেই স্থানে আবার বালু তোলা শুরু করা হয়।’ রৌমারীর ফলুয়ারচর গ্রামের হাফেজ আলী, কুটিরচর গ্রামের আলমাছ হোসেন, বলদমারা গ্রামের আব্দুর রশিদরা অভিযোগ করেন, নদের তীরে যেভাবে বালু তোলা হচ্ছে তা বন্ধ করা না গেলে বিশাল এলাকা ভাঙ্গনের মুখে পড়বে। পাউবো’র ভাঙ্গন রোধে কোনো প্রকল্পই কাজে আসবে না। বন্দবেড় ইউপি চেয়ারম্যান কবীর হোসেন বলেন, ‘বালু ব্যবসায়িরা খুবই শক্তিশালী। কোন ক্রমেই তাদেরকে দমন করা যাচ্ছেনা। প্রশাসনও কোন ব্যবস্থা না নিচ্ছে না।’
অবৈধ বালু ব্যবসায়িরা হলেন, রৌমারীর কুটিরচর খানপাড়ার ছবির খান, ছোরমান খান, রিয়াজুল হক, ফলুয়ারচর গ্রামের আবু সাইদ মিয়া, বাগুয়ারচর গ্রামের জিয়াউর, মোহাম্মদ আলী, মজিবর রহমান, বলদমার গ্রামের এবাদ আলী, ফারুক হোসেন, আমজাদ হোসেন, বাছের আলী, রাশেদুল হক। রাজীবপুরের মোহনগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন, মদনের চরের জিয়া রহমান, আব্দুর রশীদ, ফজর আলী।
রাজীবপুর ইউএনও নবীউল ইসলাম অবৈধ বালু উত্তোলন প্রসঙ্গে বলেন, ‘বালু ব্যবসায়িদের নোটিশ দেয়া হয়েছে। নদের তীর থেকে বালু তোলা যাবে না। তারা যদি বন্ধ না করেন তাহলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ রৌমারী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) গোলাম ফেরদৌস সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সরেজমিনে পরিদর্শন করে অবৈধ বালু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। কুড়িগ্রাম পাউবো নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল হক বলেন, ‘প্রকল্প স্থানে কখনও বালু উত্তোলন করা যাবে না। আমাদের উপসহকারি প্রকৌশলীদের এ বিষয়ে কড়া নির্দেশনা দেয়া আছে।’ অনিয়ম দুর্নীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখনও কেউ আমার কাছে অভিযোগ নিয়ে আসেনি। তারপরও খোঁজ নিয়ে দেখব।’

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Back to top button