জাতীয়রাজনীতিলিড নিউজ

যুবলীগ চালাতেন সম্রাট

গ্রেপ্তার হওয়া যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাটের উত্থান বিস্ময়কর। ক্যাসিনো ব্যবসা, চাঁদাবাজি, নির্যাতনের মাধ্যমে অর্থ আদায়সহ হেন অভিযোগ নেই যা তার বিরুদ্ধে ছিল না। বছরের পর বছর ধরে তিনি এসব অপকর্ম করে গেলেও কেউ তার বিরুদ্ধে ‘টুঁ শব্দ’ করারও সাহস পেতেন না। নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী দিয়ে বহু ব্যবসায়ীকে তার কার্যালয়ে তুলে নিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অসংখ্য অভিযোগ থাকার পরও সম্রাটের নামে কেউ কখনো মামলা দেওয়ার সাহস পাননি।

ক্যাসিনো ব্যবসার পাশাপাশি চাঁদাবাজিতেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন সম্রাট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা জাকাত এবং দানের টাকা দেন যে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামে সেখানেও চাঁদা দাবি করে সম্রাট বাহিনী। কাকরাইলে আঞ্জুমানের ভবন তৈরির সময় ১০ কোটি টাকা চাঁদা চেয়েছিলেন সম্রাট ও তার লোকজন। ওই চাঁদা দাবির খবর গণমাধ্যমে আসার পর প্রধানমন্ত্রী নিজেও তার ওপর ক্ষুব্ধ হন।

পুলিশ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের মতো একটি বড় ইউনিটের সভাপতি হওয়ায় সম্রাটের সঙ্গে সবসময়ই থাকত বিশাল বাহিনী। তিনি কাকরাইলের অফিসে থাকার সময় কয়েকশ নেতাকর্মী সবসময় তাকে ঘিরে রাখত। অফিস থেকে বের হয়ে কোথাও গেলে তাকে প্রটোকল দিত শতাধিক নেতাকর্মী।

নরসিংদীর জেলার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন তৈরি পোশাক ব্যবসায়ী বলেন, ‘কোনো একটি দুর্বল মুহূর্তের ভিডিও সম্রাট ও তার লোকজনের কাছে চলে যায়। ওই ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি দিয়ে তার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করা হয়। এছাড়াও ওই ভিডিওর ভয় দেখিয়ে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের অর্থ নিত সম্রাটের লোকজন।’ এছাড়াও সম্রাট বড় বড় ব্যবসায়ীকে চাঁদার জন্য ফোন করলে সে অনুযায়ী তাকে চাঁদা দিতে হতো। অফিসে বসেই নিয়ন্ত্রণ করতেন টেন্ডারসহ বিভিন্ন ঠিকাদারি।

বিতর্কিত যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের জন্ম ফেনীর পরশুরাম উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের পূর্ব সাহেবনগর গ্রামে। তার বাবা ফয়েজ আহমেদ ছিলেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। বাড়ি পরশুরামে হলেও সেখানে তাদের পরিবারের কেউ থাকে না। বাবার চাকরির সুবাদে ঢাকায় বড় হন সম্রাট।

১৯৯৬ সালের দিকে ঢাকা মহানগরীর ৫৩ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ওই সময় থেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠতে থাকেন তিনি। ওই ওয়ার্ডের সভাপতি লুৎফুর রহমানকে মারধরের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় সম্রাটসহ তিনজনকে সংগঠন থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সেটা বাস্তবায়িত হয়নি। পরে রমনা থানা যুবলীগের মনোনীত হন। ২০০৩ সালে যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন সম্রাট। সে সময় দক্ষিণের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মহি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন।

পরবর্তী সময়ে ২০১২ সালের কাউন্সিলে সম্রাট যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি নির্বাচিত হন। দক্ষিণ যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা রিয়াজুল ইসলাম মিল্কীর হত্যাকাণ্ডের পর তার সাম্রাজ্য দখল করে সম্রাটের শনৈ শনৈ উন্নতি হয়। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান সম্রাট। কিন্তু এ আসনটি জোটের প্রার্থী রাশেদ খান মেননকে দেওয়ায় তিনি মনোনয়ন পাননি। এ নিয়ে তিনি বিভিন্ন সময় ক্ষোভও প্রকাশ করেন।

রাজধানীর রমনা, মতিঝিল, ফকিরাপুল, পল্টন, কাকরাইল, বাড্ডা এলাকায় অপরাধজগতে একক আধিপত্য বিস্তার করেন সম্রাট। তিনি ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে মিলে অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্রাটের ঘনিষ্ঠ দুই সহচর হলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ এবং যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ। যুবলীগ নামধারী ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীমও সম্রাটকে অবৈধ আয়ের ভাগ দিতেন। সম্রাটকে ব্যবহার করে টেন্ডার বাগিয়ে নিতেন শামীম। তিনি এবং তার সহযোগীরা প্রশাসনসহ বিভিন্ন মহলে টাকা দিয়ে সবকিছু ম্যানেজ করতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

সম্রাটের ঘনিষ্ঠজনরা জানান, ঢাকায় দলীয় সমাবেশগুলো সফল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখতেন সম্রাট। টাকা ও জনবল সরবরাহের কাজ করতেন তিনি। এসবের মাধ্যমে যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। তিনি সম্রাটকে শ্রেষ্ঠ সংগঠক ঘোষণা করেন। ওমর ফারুক চৌধুরী চেয়ারম্যান ও হারুন রশিদ সাধারণ সম্পাদক হলেও যুবলীগের সবকিছু চলত সম্রাটের ইচ্ছে মোতাবেক।

সম্রাট মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার পর কাকরাইলে রাজমণি সিনেমা হলের উল্টো দিকে বিশাল এক ভবনের পুরোটাজুড়ে অফিস শুরু করেন। সাংগঠনিক কাজের কথা বলা হলেও এখানে বসেই সম্রাট ক্যাসিনো ব্যবসা থেকে শুরু করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এখানে থাকত তার কর্মী বাহিনী ও অপকর্মের সঙ্গীদের আনাগোনা।

সম্রাটের বড় ভাই বাদল চৌধুরী ঢাকায় তার ক্যাসিনো ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। ছোট ভাই রাশেদ চৌধুরী ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত। সম্রাটের মা বড় ছেলের সঙ্গে ঢাকায় থাকেন। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর সম্রাটের পরিবারের সবাই গা ঢাকা দেন। সম্রাট আগে থাকতেন মহাখালীর বাসায়। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় দুই বছর তিনি ওই বাসায় যান না। সম্রাটের দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন চৌধুরীও বিষয়টি স্বীকার করেন।

সম্রাটের ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘ক্যাসিনো সম্রাট’ রাজধানীর জুয়াড়িদের কাছে বেশ পরিচিত নাম। সম্রাটের নেশা ও ‘পেশা’ ছিল জুয়া খেলা। তিনি একজন পেশাদার জুয়াড়ি। সম্রাটের দ্বিতীয় স্ত্রীও দাবি করেছেন জুয়া খেলা ছিল সম্রাটের নেশা।

সম্রাটের ঘনিষ্ঠজনদের মতে, জুয়া খেলার জন্য প্রতি মাসে অন্তত ১০ দিন সিঙ্গাপুরে কাটাতেন সম্রাট। যাওয়ার সময় সেখানে ডলারের বস্তা নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বড় জুয়ার আস্তানা মেরিনা বে স্যান্ডস ক্যাসিনোতে পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ থেকেও আসেন জুয়াড়িরা। কিন্তু সেখানেও সম্রাট ‘ভিআইপি জুয়াড়ি’ হিসেবে পরিচিতি পান। প্রথম সারির জুয়াড়ি হওয়ায় সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি এয়ারপোর্টে তাকে রিসিভ করার বিশেষ ব্যবস্থা ছিল।

এয়ারপোর্ট থেকে মেরিনা বে স্যান্ডস ক্যাসিনো পর্যন্ত তাকে নিয়ে যাওয়া হতো বিলাসবহুল ‘লিমুজিনে’। সিঙ্গাপুরে জুয়া খেলতে গেলে সম্রাটের নিয়মিত সঙ্গী হতেন যুবলীগ দক্ষিণের সহসভাপতি এনামুল হক আরমান, মমিনুল হক সাঈদ ওরফে সাঈদ কমিশনার, সম্রাটের ভাই বাদল ও জুয়াড়ি খোরশেদ আলম। এদের মধ্যে সাঈদ কমিশনারের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিনি ১০ বছর আগে ঢাকায় গাড়ির তেল চুরির ব্যবসা করতেন। কাউন্সিলর হওয়ার পর তিনি এলাকায় যান হেলিকপ্টারে চড়ে। এমপি হওয়ার জন্য প্রচারও চালাচ্ছিলেন এলাকায়। মতিঝিলে তিন ক্লাবের সভাপতি এই সাঈদ।

আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪ সেপ্টেম্বর দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় যুবলীগ নেতাদের নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি যুবলীগের কয়েকজন নেতার কথা উল্লেখ করে বলেন, তারা শোভন-রাব্বানীর চেয়েও খারাপ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুবলীগের ঢাকা মহানগরের একজন নেতা যা ইচ্ছে করে বেড়াচ্ছে, চাঁদাবাজি করছে। এরপরই ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু করে র‌্যাব।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর গুলশানের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় খালেদ মাহমুদকে। তাকে গ্রেপ্তারের পরপরই মতিঝিলসহ রাজধানীর কয়েকটি অভিজাত ক্লাবে অভিযান চালিয়ে ক্যাসিনোসামগ্রী জব্দ ও ক্লাব সিলগালা করে র‌্যাব-পুলিশ। খালেদ গ্রেপ্তারের সময় কাকরাইলের নিজ কার্যালয়ে নেতাকর্মী পরিবেষ্টিত অবস্থায় ছিলেন সম্রাট। পরে সেখান থেকে আত্মগোপন করেন। এ সময় কোনো কোনো গণমাধ্যমে সম্রাটকে হেফাজতে নেওয়ার খবরও প্রকাশিত হয়।

এর মধ্যে গত ২৪ সেপ্টেম্বর সম্রাটের ব্যাংক হিসাব জব্দ ও লেনদেন স্থগিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরদিন ২৫ সেপ্টেম্বর সম্রাটের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button