জাতীয়

ব্যাংকারদের বেতন বাড়ানোর সিদ্ধান্তে যা বলছে বিএবি-এবিবি

বেসরকারি ব্যাংকে কর্মী নিয়োগে সর্বনিম্ন বেতন নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা প্রজ্ঞাপনকে ‘অবাস্তব ও অযৌক্তিক’ দাবি করছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। বেসরকারি ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি সরকারি বেতন কাঠামোর সঙ্গে ব্যাপকভাবে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। যা বাস্তবায়ন করতে গেলে ব্যাংকগুলো নতুন শাখা খোলা দূরের কথা, বিদ্যমান অনেক শাখা বন্ধ করতে বাধ্য হবে।

তারা বলছেন, এতে সরকারের গ্রামকে শহরায়ন, গ্রামে বসেই চাকরি, নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি, গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। বিনিয়োগবান্ধব ঋণের সুদহার আবার বাড়িয়ে দেবে এ অবাস্তব বেতন কাঠামো। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবি জানিয়েছে ব্যাংকের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি)।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার (২০ জানুয়ারি) জারি করা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ব্যাংকে কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষনবিশকালে সর্বনিম্ন বেতন হবে ২৮ হাজার টাকা আর শিক্ষনবিশকাল শেষ হলে বেতন হবে ৩৯ হাজার টাকা। নিরাপত্তাপ্রহরী, অফিস সহকারী, গাড়ি চালক ইত্যাদি সাপোর্ট স্টাফদের নিয়োগে সর্বনিম্ন বেতন হবে ২৪ হাজার টাকা। ব্যাংকগুলো এখন ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে নতুন নতুন শাখা খুলছে। কম খরচে গ্রামের মানুষকে সেবা দিতে উপশাখা খুলছে। ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারি ও অন্যান্য বেসরকারি খাতের কর্মীদের বেতনের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত সর্বনিম্ন বেতন অনেক বেশি।

এতে আরও বলা হয়, উপজেলা পর্যায়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সরকারি সংস্থার পিয়ন, পুলিশ কনস্টেবল, বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মী নিয়োগের বেতন কাঠামো পর্যালোচনা না করে অযৌক্তিকভাবে ব্যাংকের বেতন কাঠামো নির্ধারণ করা হয়েছে। গ্রামের ব্যাংকিং ব্যবসার পরিধি অনেক কম। তাই সেখানে এত বেশি বেতন দিয়ে কর্মী নিয়োগ করে সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত পরিপালন করতে হলে অবশ্যই গ্রামের শাখা বন্ধ করতে হবে। এতে গ্রামীণ উন্নয়ন বন্ধ হয়ে যাবে।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সূত্র জানায়, করোনাকালে গত দুই বছর সরকারি ও বেসরকারি প্রায় সবখাতেই নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ। তবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো শাখা বিস্তারে নতুন নতুন কর্মী নিয়োগ দিচ্ছে। এই নতুন কর্মী নিয়োগ করার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা চাপ প্রয়োগ করে নিজেদের সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনদের নিয়োগ দিতে বাধ্য করেছে। অথচ যাদের অধিকাংশেরই শিক্ষাগত যোগ্যতা অনেক কম। চাপ প্রয়োগ করে যে কোনো পর্যায়ে নিয়োগ করানো হচ্ছে। এখন নিজেদের সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনদের স্থায়ীভাবে ভালো অবস্থানে নিতে ব্যক্তিস্বার্থে এ প্রজ্ঞাপন জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসরকারি ব্যাংকের একজন এমডি  বলেন, পরিদর্শন, নতুন শাখা ও সেবা, নিত্যদিনের কার্যক্রমে বিভিন্ন পর্যায়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন প্রয়োজন পড়ে। অনুমোদন নিতে গেলে ফাইল আটকে নিজেদের আত্মীয়-স্বজনদের নিয়োগ দিতে বাধ্য করেছেন। করোনাকালে এটি ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এখন নিজেদের সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনদের বেতন বাড়ানো এবং স্থায়ী ব্যবস্থা করতে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী এ সার্কুলার জারি করেছে। গত কয়েক বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সন্তান ও আত্মীয়-স্বজন বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে কীভাবে চাকরি পেয়েছে, তা স্বাধীনভাবে তদন্ত করার দাবি জানাচ্ছি আমরা।

দেশে সরকারি ও বেসরকারি উভয়খাতের ব্যাংক রয়েছে। কিন্তু কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। আইন সবার জন্য না করে একটি খাতের জন্য করা হয়েছে। এটি সংবিধানের লঙ্ঘন। কারণ এই নীতি পরিপালনে সরকারি ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে বেসরকারি ব্যাংক। এছাড়া সরকার ঋণের সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদ কার্যকরের জন্য নিয়ম জারি করেছে। বেতন বাড়ানোর ফলে ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। ফলে ৯ শতাংশ সুদ কার্যকর করা সম্ভব হবে না। এ প্রজ্ঞাপন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতার অপব্যবহার।

বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, দারিদ্র্য ও বেকারমুক্ত সোনার বাংলা গড়তে সরকার গ্রামকে শহরায়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এ কাজে সবচেয়ে বেশি সহায়ক ব্যাংক খাত। ব্যাংকগুলো নিজেরা গ্রামে গিয়ে শাখা খুলে কর্মী নিয়োগ করছে। আবার নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে ঋণ দিচ্ছে। কিন্তু উচ্চ বেতনে কর্মী নিয়োগে বাধ্য হলে গ্রামে শাখা খোলার উদ্যোগই বন্ধ করতে হবে। গ্রামের মানুষের কর্মের সুযোগ এবং অর্থায়নের উৎস বন্ধ হবে। আগে গ্রামের মানুষ এনজিও থেকে ২২ থেকে ২৪ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হতো। এখন উপশাখার কারণে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে পারছেন। এটিও বন্ধ হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে কর্মীদের দক্ষতা বিচারের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো দক্ষতা বিচারে প্রতিবছর সেরা কর্মীদের পুরস্কৃত করে এবং অদক্ষতাদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে অদক্ষ এবং অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিধি অনুসারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। এই মূল্যায়ণ পদ্ধতিও কার্যত বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ব্যাংকারদের দাবি, নতুন বেতন কাঠামো কার্যকরের আগে ব্যাংকের আয় বাড়ানোর সুযোগ করে দিতে হবে। এজন্য বিভিন্ন সেবার মাসুল (সার্ভিস চার্জ), সরকারি সেবার বিপরীতে প্রদত্ত কমিশন, ঋণের সুদহার বাড়াতে হবে। অন্যদিকে প্রভিশন ও করপোরেট কর কমাতে হবে। আনুপাতিক হারে সরকারি সংস্থার স্থায়ী আমানত সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ হারে বেসরকারি ব্যাংকে রাখতে হবে। যেহেতু বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিচ্ছে, তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক আয় বাড়িয়ে কীভাবে টিকে থাকবে সে সিদ্ধান্তও কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই নিতে হবে। বর্ধিত ব্যয় কোন খাত থেকে আয় করে মেটাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেটি নির্ধারণ করে দিক।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button