শুদ্ধি অভিযানের ঢেউ রেলেও
শুদ্ধি অভিযানের ঢেউ লেগেছে রেলেও। এতদিন যারা দুর্নীতির কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পকেটে পুরেছেন, তাদের বিরুদ্ধে এবার ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। রেলের ‘কালো বিড়াল’ অর্থাৎ দুর্নীতিবাজদের তালিকা করেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। এখন ওই তালিকা চূড়ান্ত করার কাজ চলছে। সূত্র বলছে, শিগগিরই তালিকা চূড়ান্ত করে তা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট স্থানে পাঠানো হবে।
সূত্র জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত তালিকায় অন্তত ২০ জনের নাম রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন সাবেক কয়েকজন মহাপরিচালক (ডিজি), মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ও অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি)। কয়েকজন প্রকৌশলী, বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কয়েকজন ঠিকাদারের নামও রয়েছে এতে। এর বাইরে বর্তমানে কর্মরত জিএম, প্রকৌশলী ও বাণিজ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের কয়েকজনও নজরদারিতে রয়েছেন, শেষ পর্যন্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে তাদের নামও।
রাজনৈতিক বা ক্ষমতার দাপটে এতদিন যারা রেলভবনে ছড়ি ঘুরিয়েছেন, দুর্নীতির মাধ্যমে টাকা কামিয়েছেন, কাজে ফাঁকি দিয়ে বা কাজ না করেই অর্থ লুটে নিয়েছেন- তালিকা প্রস্তুতির খবরে তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ। তালিকায় যেন নাম না থাকে, এজন্য তদবির করে বেড়াচ্ছেন তাদের অনেকেই। এমনকি এখন দেশ ছাড়ার চেষ্টায়ও রয়েছেন কেউ কেউ। তবে গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, এসব ব্যক্তির চলাফেরা ও কার্যক্রমের ওপর নজর রাখা হচ্ছে। সূত্রমতে, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি তাদের স্ত্রী ও সন্তানের সম্পদের অনুসন্ধানও চালানো হচ্ছে। বিশেষ করে, যাদের পরিবারের সদস্য বিদেশে বিলাসী জীবনযাপন করছেন, বিদেশে ব্যয়বহুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যার ছেলেমেয়ে পড়ালেখা করছে, তাদের আয়ের উৎস সম্পর্কে খোঁজ নেয়া হচ্ছে। রাজধানীতে বাড়ি ও ফ্ল্যাটের মালিক কর্মকর্তারাও নজরদারির মধ্যে রয়েছেন।
সূত্র জানায়, প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও এতদিন যেসব কর্মকর্তা প্রকল্পের অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে বিদেশে ঘুরেছেন, তাদের নামও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, বিগত ১০ বছরে যারা বিদেশে গেছেন, তাদের তালিকা চেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। আর যেসব কর্মকর্তা ঘন ঘন বিদেশে গেছেন, তাদের সম্পদের খোঁজে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দারা। সম্প্রতি সংসদীয় কমিটি এক নির্দেশনায় গত ১০ বছরে কোন কর্মকর্তা কতবার বিদেশে গেছেন, কী কারণে গেছেন, কোন কোন প্রকল্পের আওতায় গেছেন, এর তথ্য-উপাত্ত চেয়েছে। প্রকল্পের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা কতটুকু, তা-ও এতে জানাতে বলা হয়েছে।
সূত্র জানায়, রেল খাতের উন্নয়নে বহু কোটি টাকার বরাদ্দ হলেও বড় অঙ্কের অর্থ খেয়ে ফেলছে ‘উইপোকারা’। প্রতিবছর বড় অঙ্কের বাজেট হলেও বাস্তবে যথাযথ উন্নয়ন হয়নি। চলমান প্রকল্পের বেশির ভাগই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। কয়েক দফা ব্যয় বৃদ্ধির পরও প্রকল্পের কাজ শেষ হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাঠপর্যায়ে লাগামহীন দুর্নীতির কারণে রেলওয়ের উন্নয়ন দৃশ্যমান হচ্ছে না। উল্টো দিন দিন রেলপথ মরণফাঁদে পরিণত হচ্ছে।
রেলপথ নিরাপদ রাখতে যেসব কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করার কথা, তাদের নিয়েও নানা অনিয়মের প্রসঙ্গ উঠছে। রেলপথের পাথর থেকে শুরু করে নাট-বল্টু, সিগান্যালিং ব্যবস্থা দেখভালে রয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি। চলছে তেল চুরি। মাঠপর্যায়ে কাজ না করেও বহু কর্মচারী মাসের পর মাস বেতন তুলে নিচ্ছেন। কর্মকর্তারা তাদের কাছ থেকে পাচ্ছেন মাসোহারা। আর ক্ষণে ক্ষণে ট্রেন দুর্ঘটনায় পড়ে এসবের খেসারত দিচ্ছে রেল ও সাধারণ যাত্রী।
সূত্র বলছে, কয়েকজন অসাধু ঠিকাদারের নামও আছে তালিকায়। রেলকেন্দ্রিক সব উন্নয়ন কাজের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন যুবলীগ নেতা খালেদ ভূঁইয়া, যিনি ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে সম্প্রতি গ্রেফতার হয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খালেদের ওপর ভর করেই দুর্নীতি জায়েজ করতেন রেলের অসৎ কর্মকর্তারা। এমনও অভিযোগ রয়েছে, কর্মকর্তাদের কেউ কেউ বিভিন্ন হোটেলে গভীর রাতে খালেদের সঙ্গে মদের আড্ডা জমাতেন। পল্টনের একটি চাইনিজ রেস্তোরাঁয় নিয়মিত চলত ঘুষের লেনদেন। এসব কর্মকর্তার কী পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, রাজধানীতে কয়টি ফ্ল্যাট কিংবা প্লট, গ্রামের বাড়িতে কী পরিমাণ জায়গাজমি কিনেছেন, বাড়ি নির্মাণ করেছেন- সেটিও খুঁজে দেখা হচ্ছে।
রেল খাতে দুর্নীতি-অনিয়ম বন্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কিছুদিন আগে একটি প্রতিবেদন দেয়। এতে দুর্নীতির ১০টি উৎস চিহ্নিত করে তা বন্ধে ১৫টি সুপারিশ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, রেলওয়ের ওয়ার্কশপগুলো কার্যকর না করে ট্রেনের যন্ত্রাংশ আমদানির মাধ্যমে বড় ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি, রেলের স্লিপার নির্মাণ কারখানা অকার্যকর রেখে সরকারের আর্থিক ক্ষতি, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল (চট্টগ্রাম) ও পশ্চিমাঞ্চলের (রাজশাহী) অধীনে ‘বিপুল পরিমাণ’ সম্পত্তি লিজ ও হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, রেলওয়ের অধীনে ওয়াগন, কোচ, লোকোমোটিভ, ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট কেনা ও সংগ্রহে অনিয়ম, রেলওয়ের ডাবল লাইন, সিঙ্গেল লাইন, ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণকাজে অনিয়ম এবং রেলের বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগে দুর্নীতি রয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, এসব দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের নাম শুদ্ধি অভিযানের জন্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।
রেলে শুদ্ধি অভিযানের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রেলপথমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন শনিবার বলেন, প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে অভিযান শুরু করেছেন, রেল তাকে স্বাগত জানায়। রেল খাতে যদি দুর্নীতিবাজ থেকে থাকে, তাদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের জন্য রেলওয়ের এত উন্নয়ন, বর্তমান সরকারের সফলতা নস্যাৎ হতে পারে না।
তিনি বলেন, আমার যোগদানের আগে যদি দুর্নীতি-অনিয়ম কিংবা নিয়োগ কেলেঙ্কারি হয়ে থাকে- সেটার দায়-দায়িত্ব আমি নেব না। তবে আমি চাই, আইন অনুযায়ী সেসব দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হোক। আমার যোগদানের পর যদি কোনো কর্মকর্তা বা মন্ত্রণালয়ের কারও দুর্নীতি-অনিয়মের তথ্য মিলে, তার বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।