রংপুর বিভাগসারাদেশ

মুক্তিযুদ্ধে হত্যার পর মাহতাব বেগের কাটা মাথা নিয়ে উল্লাস করা হয়েছিল সৈয়দপুর শহরে

 নীলফামারী জেলা প্রতিনিধি: ইংরেজ শাসনামলে নীলফামারীর সৈয়দপুর স্থাপিত রেলওয়ে কারখানায় চাকরির সুবাদে  ভারতের বিহার রাজ্য থেকে  এখানে আশ্রয় নিয়েছিল উর্দুভাষিরা। ধীরে ধীরে তারা এ শহরে হয়ে ওঠে  সংখ্যাগরিষ্ঠ। একাত্তরে তাদের  নির্যাতন অত্যাচারের শিকার হন বাঙালীরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পর বাঙালিদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় সৈয়দপুরের  অবাঙালিরা। দিনে দিনে সৈয়দপুরের বাঙালিরা শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে যেতে শুরু করেন।

মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের সংগঠিত করতে নেতৃত্ব দেন তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য শহীদ জিকরুল হকসহ অনেকে। সে সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের আটকে রেখে বিমানবন্দরে মাটি কাটার কাজে লাগিয়ে দেয় ও বাঙালিদের ওপর জুলুম, নির্যাতন চালায়।
১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে সৈয়দপুরের বাঙালিরা মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ান। এ নিয়ে বাঙালিদের অবরুদ্ধ করে অবাঙালিরা।

খবর পেয়ে ২৪ মার্চ সকালে  চারদিক থেকে সৈয়দপুর ঘেরাও শুরু করেন বাঙালিরা। বেলা ১১টায় সৈয়দপুরের পূর্ব দিকে গোলাগুলি শুরু হয়। দুপুর ১২টায় রানীরবন্দরের সাতনালা ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান মাহাতাব বেগ শহরের পশ্চিম দিক থেকে সৈয়দপুরের দিকে এগোতে থাকেন। তার সঙ্গে কয়েক হাজার জনতা যোগ দেন। মাহাতাব বেগ একটি পয়েন্ট টুটু বোর রাইফেল ও পিস্তল নিয়ে সৈয়দপুর ঘেরাও করতে যান। সাধারণ জনতার হাতে ছিল তীর-ধনুক, লাঠি-সোঁটা আর বল্লম।

মাহাতাব বেগের সঙ্গে হাজার হাজার জনতা সৈয়দপুরের দিকে এলে খড়খড়িয়া নদীর সামনে পাকিস্তানি সেনাসহ অবাঙালিরা গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে গুলিবিদ্ধ হন মাহাতাব বেগ। তিনি গুলিবিদ্ধ হওয়ায় সাধারণ মানুষের ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। দুই পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও গুলিবর্ষণ চলতে থাকে। গুলিবিদ্ধ মাহাতাব বেগকে বাঁচাতে এসে নিহত হন মোহাম্মদ আলী নামের একজন বাঙালি রেলওয়ে শ্রমিক।

পাশাপাশি মাহাতাব বেগের ভাই ও ছেলেদের সঙ্গে পাকসেনা এবং অবাঙালিদের গোলাগুলি চলতে থাকে। তখন গুলিবিদ্ধ হন মাহাতাব বেগের ছেলে মির্জা সালাউদ্দিন বেগ। পাকসেনা ও অবাঙালিদের গুলি ও হাতবোমার তাণ্ডবে মাহাতাব বেগকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রেখে খড়খড়িয়া নদীর ওপারে চলে যান সাধারণ জনতা।

সেদিন পাকসেনার গুলিতে নিহত রেলওয়ে শ্রমিক মোহাম্মদ আলীর মরদেহ তার পরিবার পেলেও মাহাতাব বেগের মরদেহ সৈয়দপুর শহরে নিয়ে যান পাকসেনারা।

মাহাতাব বেগের ছেলে মির্জা মো. সালাউদ্দিন বেগ (৬৮)  বলেন, শহরে আনার পর কসাই ডেকে আমার বাবা মাহাতাব বেগের মাথা কেটে আলাদা করে বল্লমের মাথায় ছিন্ন মস্তক নিয়ে গোটা শহরে উল্লাস করেছিল অবাঙালিরা। সেদিন তারা হুমকি দিয়েছিল পাকিস্তানের বিরোধিতা করলেই সবার অবস্থা মাহাতাব বেগের মতো হবে। মূলত এটিই ছিল পাকবাহিনী ও সৈয়দপুরের অবাঙালিদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের প্রথম প্রত্যক্ষ প্রতিরোধ যুদ্ধ। আমিও সেদিন  গুলিবিদ্ধ হয়েছিলাম।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন ‘দুঃখ হয় স্বাধীনতার এত বছর পরও সৈয়দপুরে এখনো অবাঙালিদের রাজত্ব চলে। সৈয়দপুরের অবাঙালিরা এখনো উদুর্তেই কথা বলছে, মাইকিং করছে। দেশ স্বাধীন হলেও সৈয়দপুরে বেড়ে ওঠা এই প্রজন্ম প্রকৃত স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত। দেখে মনে হয় সৈয়পুর এখনো স্বাধীন হয়নি।’

শহীদ মাহাতাব বেগ স্মৃতি সংসদের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মো. সুজাউদ্দৌলা সুজা বলেন,নতুন প্রজন্মের কাছে  মাহাতাব বেগের স্মৃতিকে ধরে রাখতে আজও নির্মাণ করা হয়নি কোনো স্মৃতিস্তম্ভ। তাঁর নামে কোনো সড়ক কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়নি।

মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর মাহাতাব বেগের পরিবার থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এমএ রশিদ বেগ, মির্জা সালাউদ্দিন বেগ, আব্দুর রউফ বেগ, আব্দুল মজিদ বেগ ও মৃত ওয়াহেদ আলী বেগ।

সৈয়দপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার একরামুল হক বলেন,  মাহাতাব বেগের নেতৃত্বে অবরুদ্ধ বাঙালিদের বাঁচাতে চম্পাতলী থেকে সৈয়দপুর ঘেরাও আন্দোলন হয়েছিল; এটি সৈয়পুরে পাকসেনা ও তার দোসরের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ।  মুক্তিযুদ্ধে তিনিই সৈয়দপুরে প্রথম শহীদ।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button