দুর্যোগলিড নিউজশিক্ষাঙ্গনসারাদেশ

‘চরিত্রহীন’ অপবাদ দিয়ে স্কুলছাত্রীকে মারধর ও জরিমানা

মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে চরিত্রহীন অপবাদ দিয়ে গ্রাম্য সালিশি বৈঠকে এক স্কুলছাত্রী ও তার তিন বন্ধুকে জরিমানা করেন স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। জরিমানার টাকা না দেওয়ায় মারধর করা হয় ওই ছাত্রীসহ তার পরিবারের লোকজনকে।

নির্যাতন ও মিথ্যা অপবাদ সইতে না পেরে টয়লেট ক্লিনার (হারপিক) খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ওই স্কুলছাত্রী। উপজেলার রামকৃঞ্চপুর ইউনিয়নের পিয়াজচর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত ৯ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে।

মামলার এজহার ও পরিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ভুক্তভোগী স্কুলছাত্রী হরিরামপুর উপজেলার পিয়াজচর গ্রামে তার নানার বাড়ি থেকে স্থানীয় উচ্চ বিদ্যলয়ের অষ্টম শ্রেণীতে পড়াশোনা করেন। স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে প্রায়ই প্রতিবেশি রানা, হৃদয়, সজিব, কালাম, আসিফ ও রাকিবসহ কয়েকজন বখাটে তাকে উত্যক্ত করে আসছিল। স্কুলছাত্রী বিষয়টি তার পরিবারকে জানালে বখাটেরা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে।

অভিযোগ সূত্রে আরো জানা যায়, গত ১৮ আগস্ট রবিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে স্কুলছাত্রীর তিন বন্ধু তার নানার বাড়িতে বেড়াতে আসে। সে বন্ধুদের ঘরে নিয়ে আপ্যায়ন করছিল। এ সময় বখাটে রানা, হৃদয়, সজিব, কালাম, আসিফ ও রাকিব বাইরে থেকে ঘরের তালা ঝুলিয়ে দিয়ে এলাকার মাতবর ও প্রভাবশালী কয়েকজন ব্যক্তিকে ডেকে আনেন। এ সময় স্কুলছাত্রীকে চরিত্রহীন অপবাদ দিয়ে রাতেই সালিশি বৈঠক বসানো হয়।

স্থানীয় ইউপি সদস্য মাহাব আলী, সাবেক সদস্য আয়নাল হকের উপস্থিতিতে সালিশি বৈঠকে স্কুল ছাত্রীর পরিবারকে ৪০ হাজার ও তিনি বন্ধুকে ২০ হাজার টাকা করে ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। সালিশি বৈঠকে উপরোল্লিখত দুই ব্যক্তি ছাড়াও এলাকার মাতবর জনাব আলী (জুনি), কাঞ্চন মাস্টার, লুৎফর, খলীল কাজী ও আবুলসহ অর্ধশতাধিক মানুষ উপস্থিত ছিলেন।

গত ২০ আগস্ট বিকাল ৪টার দিকে ওই স্কুলছাত্রীর বাড়িতে জরিমানার টাকা আনতে যান গ্রাম্য মাতবর লুৎফর রহমান ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। জরিমানার টাকা না দেওয়ায় ওই সময়ই তারা বাঁশ, লোহার রড ও কাঠের লাঠি নিয়ে স্কুলছাত্রী ও তার নানা বাড়ির লোকজনের ওপর হামলা করে।
হামলাকারীরা লুটে নেয় স্বর্ণালংকারসহ অর্ধলক্ষ টাকার মালামাল। এ সময় স্কুলছাত্রীসহ তার নানী, খালা ও খালাতো বোন গুরুতর আহত হন। আহতদের হরিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

এর একদিন পর ২১ আগস্ট মিথ্যা অপবাদ ও নির্যাতনের লাজলজ্জার ভয়ে টয়লেট ক্লিনার (হারপিক) খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ওই স্কুলছাত্রী। পরে তাকে ঢাকার সাভার এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সে এখন শঙ্কামুক্ত।

এ ঘটনায় স্কুলছাত্রীর বাবা বাদী হয়ে উপজেলার পিয়াজচর গ্রামের লুৎফর রহমান, তার স্ত্রী রেহেনা বেগম, ছেলে রানা, মেয়ে এলমা বেগম, একই গ্রামের সাম্পুর ছেলে হৃদয়, রিপন মিয়ার ছেলে সজীব, ইজ্জত আলীর ছেলে রাকিব, বাহিরচর গ্রামের ইছহাক মিয়ার ছেলে কালাম ও শেখ আসিফসহ অজ্ঞাতনামা আরো ৪-৫ জনকে আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলার ৯ আসামির মধ্যে তিনজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও তারাসহ সব আসামি কোর্ট থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। এতে আতঙ্ক বিরাজ করছে ভুক্তভোগী স্কুলছাত্রী ও তার স্বজনদের মধ্যে।

এ ব্যাপারে স্থানীয় ইউপি সদস্য মাহাব আলী ও সাবেক সদস্য আয়নাল হকের কাছে মুঠোফোনে জানতে চাইলে তারা এ বিষয়ে কোনো কথা না বলে লাইন কেটে দেন। এরপর অনেক চেষ্টা করেও তাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

রামকৃঞ্চপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামাল হোসেন বলেন, ঘটনাটি অত্যন্ত মর্মান্তিক। চেয়ারম্যান হিসেবে বিষয়টি আমাকে জানানো উচিৎ ছিল। মিথ্যা অপবাদ দিয়ে স্কুলছাত্রী ও তার স্বজনদের মারধর এবং সালিশ বৈঠক বসিয়ে জরিমানা করা ঠিক হয়নি। যারা এটা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তিনি।

হরিরামপুর থানার পুলিশ পরিদর্শক (ওসি) আমীনুর রহমান জানান, এ ঘটনায় ৯ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করে স্কুলছাত্রীর বাবা। মামলায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও তারাসহ সব আসামি এখন আদালত থেকে জামিনে আছেন। ঘটনাটির সত্যতা সাপেক্ষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে বলে জানান এই পুলিশ অফিসার।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button