রংপুর বিভাগসারাদেশ

কুড়িগ্রামের ২০টি পয়েন্টে তিস্তা নদীর ভাঙন

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি:তিস্তা পাড়ের জাহেদুল ইসলাম উঠানে বসে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পরামর্শ করছিলেন কোথায় যাবে। নদী বাড়ী উঠানে এসে লেগেছে। সবার চোখে মুখে বিষন্নতার ছায়া। আকাশ মেঘলা থেমে থেমে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ও বাতাস বইছিল। নদীর পানি বাড়ছে। উজান থেকে ঘোলা পানির স্রোত নদীর তীরে লেগে ভেঙ্গে পড়ছে। এসময় সেখানে বসা কয়েকজন চিৎকার করে উঠছে আল্লা নদীর হাত থাকি বাঁচও।
এ সময় সেখানে উপস্থিত হলে জাহেদুল ইসলাম (৬১) নামে একজন বলেন ভাইগো নদীর কাছার (নদীর পাড়) ভাঙ্গি পানিত পড়ে, হামার বুক শিলা নাগে। ভয়ে রাইতোত ঘুম আইসে না। কখন বেন বাড়ী ভাঙ্গি নদীত যায়। এই নিয়া তিনবার বাড়ী সরাইলাম। আর যে পরিনা।
শুত্রুবার সকালে কুড়িগ্রাম জেলার সীমান্ত গ্রাম রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের চর নাখেন্দায় ও গতিয়াসামে গিয়ে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। পাশেই লালমনিরহাট জেলার গকুন্ড গ্রাম ও তিস্তা সেতু। সেতুর পশ্চিম পাশে ব্লক দিয়ে পাড় বাঁধান হয়েছে। পূর্ব পাশে ফাঁকা। কোন কাজ হয়নি।
জাহেদুল ইসলাম বলেন তিস্তা নদীর পূর্ব পাশে বাঁধ দেওয়া হইলে এমন ভাঙ্গন হইতো না। দুই জেলার শেষ সীমান্ত বলে কেউ খোঁজ নেয় না। দেখেন কি অবস্থা হামার। তিস্তা নদী ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে ঘড়ের কিনারোত আসি নাগছে। যে কোন সময় নদীর প্যাটোত যাইবে।
জাহেদুলরা চার ভাই। পরিবারসহ সবাই এক সাথে থাকে। সবাই বসে আলাপ করছে কোথায় যাবে। পাশেই বসা তার ছোট ভাই সাজেদুল ইসলাম, আছাদুল ইসলাম ও রেজাউল ইসলাম। উভয়ে কৃষিজীবি। আছাদুল বলেন চার ভাই এক সাথে থাকি। হামারা যে এতো কষ্ষ্টোত পড়ছি কাইয়ো খোঁজ নিবার আইসে নাই। আগে বাড়ী আছিল নদীর পশ্চিম পাড়ে (ওপারে)। দুইবার ভাঙ্গে। গত বার এইখানে আসি উঠেছি। একে অবস্থা। খুব চিন্তা পড়ছি। নিজের জমি নাই কোটে যাম।
স্থানীয়রা জানায় তিস্তা নদী এখান থেকে (চর নাখেন্দা} কুড়িগ্রাম জেলায় প্রবেশ করে রাজারহাট, উলিপুর উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চিলমারী উপজেলায় ব্রক্ষপুত্র নদের সাথে মিলিত হয়েছে। দুরত্ব ৬৫ কি.মি। ১৬টি স্থানে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে।
এগুলো হলো গতিয়াসাম, চতুরা, বুড়িগ্রামহাট, কালীর হাট, গাবুর হেল্লা,মেদনীপুর, বিদ্যানন্দ, উলিপুর উপজেলার ঠুটাপাইকোর, দলদলিয়া, থেতরাই (গোড়াই পিয়ার) নাগরাকুরা, পশ্চিম বজরা, হোকডাঙ্গা, অজুনের পাড়, দাঁড়িয়ার পাড় ও চিলমারী কাশিম বাজারসহ ২০টি স্থানে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে।।   তিস্তা সেতু থেকে চিলমারী পর্যন্ত নদীর তীরবর্তি প্রায় ২০ কি.মি এলাকা ঘুড়ে দেখা যায় ভাঙ্গনের অবস্থা। নদীর পাড়ের মানুষের মধ্যে রিতিমত ভাঙ্গনের আতংক বিরাজ করছে। তিস্তা পাড়ের মানুষ অধিকাংশ দরিদ্র, দিমজুর, ভূমিহীন ও কৃষিজীবি। অনেকে পাশ্ববর্তি পানি উন্নয়নের বোর্ডের তীর রক্ষা বাঁধ ও আবাসনে আশ্রয় নিয়ে আছে। তাদের একটাই কথা হামরা রিলিফ চাইনা। নদী খনন কর। ভাঙ্গন থেকে বাঁচাও।
চর নাখেন্দা গ্রামের বৃদ্ধ রাশেদা বেগম এর স্মামী আনোয়ার হোসেন ঢাকায় দারোয়ানের কাজ করে। নদীর কিনারে বসে বলেন বুড়া মানুষ চলবার পায় না একজন দয়া করি বাড়ীর দারোয়ানের কাম দিছে। যা পায় তাই দিয়া চলি। স্মামী ঢাকাত থাকতে গত মাসে বাড়ী ভিটা নদীত গেইছে। গ্রামবসীরা ধরাধরি করি একটা ঘড় সামছুল মেলেটারীর বাড়ীর কানচাত থুচে। সেটে কোন রকমে পড়ি আছি।
এখান থেকে পূর্বে একটু এগিয়ে গতিয়াসাম গ্রামে। সেখানে গিয়ে দেখা যায় বিধ্বস্ত অবস্থা। ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে শতাধিক পরিবার। ইতিমধ্যে ২০ থেকে ২৫টি পরিবার ভাঙ্গনের স্বীকার হয়ে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়ে আছে। এখানে ৫টি আধা পাকা বাড়ী ভেঙ্গে নেয়া হয়েছে। বাড়ীর মালিক টুকু মিয়া জানায় এক সপ্তাহ আগে বাড়ী সরিয়েছি। পাশেই ছাপড়া তুলে পরিবারের সদস্যরা বসবাস করছি। ইতিমধ্যে গ্রামের দিন মজুর ইমান আলী ও হাসেন আলী বসত ভিটা ভেঙ্গে গেছে। নিজেস্ব জমি না তারও পাশেই আশ্রয় নিয়ে আছে। ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে হোসেন আলী, আকাশ ও মিন্টু মিয়ার বাড়ী। দিনমজুর মিন্টু মিয়া দীর্ঘ দিন থেকে অসুস্থ্য। চলতে পারে না। তিনি বলেন গরীব মানুষ বাড়ী সরাই না, খাওয়ার যোগার করি। খুব কষ্টে পড়ছি।
এসব এলাকার নদীর তীরবর্তি বসতভিটা ও ফসলী জমি, তীর রক্ষা বাঁধ, গ্রোইন, টি বাঁধ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্টান, আবাসন, মাদ্রাসা, মসজিদ মন্দির নদীতে ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে। অনেক গুলো বিলিন হয়ে গেছে।
কালীর হাট ও বুড়িরহাট, চতুড়ায় গিয়ে দেখা যায় নদী কালির হাটে এসে লেগেছে। বুড়ির হাটে গ্রোয়নটি ভাঙ্গন দেখা দিলে পানি উন্নয়ন বোর্ড জিও বস্তা ফেলে ভাঙ্গন রোধের চেষ্টা করছে। স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল জব্বার জানায় গ্রোইটি এখন আশংকা মুক্ত নয়। পাশেই মেদনী আবাসন। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে ২৪টি পরিবার ঘড় পেয়েছে। সেটিও হুমকীর মুখে। বিদ্যানন্দ ইউয়িনে গাবুরহেল্লা ক্রস বাঁধ, উলিপুর উপজেলার নাগরাকুড়া টি বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে। ঠুটাপাইকোর ও গোড়াইপিয়ারে ভাঙ্গন চলছে।
ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রবীন্দ্রনার্থ কর্মকার জানায় আমার ইউনিয়নে ৮ টি স্থানে ভাঙ্গন চলছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিবার্হী প্রকৌশরীর সাথে কথা হলে বলেন তিস্তা নিয়ে মহা পরিকল্পনার নেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমার কথা কোনদিন মহা পরিকল্পনা নিবে সেটা পরের কথা চলতি নদী ভাঙ্গনে মানুষের অবস্থা কাহিল তাক থামান।
চিলমারী কাশিমবাজারে গিয়ে দেখা যায় চলতি মাসে ভাঙ্গন দেখা দিলে পানি উন্নয়ন বোর্ড জিও ব্যাগ পেলে ভাঙ্গন ঠেকানোর কাজ করছে। ইতিমধ্যে ঐ এলাকায় শতাধিক পরিবারের বসতভিটা ভেঙ্গে গেছে। এছাড়া একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ভাঙ্গনের মুখে পড়ায় সরিয়ে নিয়েছে। মসজিদ ডেবে গেছে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায় ইতিমধ্যে এখানে ২২ হাজার জিও বস্তা ফেলা হয়েছে। এতে কিছুটা ভাঙ্গন রোধ হয়েছে। আরও জিও ব্যাগ ফেলা হবে। তিস্তা অববাহিকায় ১৬টি পয়েন্টে ভাঙ্গন অব্যাহত আছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিবাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানায় সরকার স্থায়ী ভাবে ৮হাজার ২ শত কোটি টাকার একটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধিন রয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে তিস্তা পাড়ের মানুষের দু.খ থাকবে না। তবে জরুরী ভিত্তিতে কিছু কাজ আমরা করছি। উদ্ধর্তন কৃর্তপক্ষকে প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছি। এগুলো আসলেই কাজ করা যাবে।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button