চামড়া সংরক্ষণ: বকেয়া নিয়ে অসন্তুষ্ট আড়তদাররা

করোনা মহামারির এই সময়ে কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণ নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা সঙ্কট। পুরনো বছরের বকেয়া জমে থাকায় আড়তদারদের অসন্তোষ, কোরবানির পর চামড়া সংরক্ষণে ব্যক্তিগত অসর্তকতা ও প্রস্তুতির অভাবে এবারও আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এ বছর চামড়া সংরক্ষণে তারা দেশব্যাপী পর্যবেক্ষণ জোরদার করছেন। পর্যাপ্ত লবণ মজুদ থাকায় চামড়া সংরক্ষণে সমস্যা হবে না।
চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকার বাইরে অনেক এলাকায় ফড়িয়া ও আড়তদারদের মধ্যে মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত চামড়া কেনাবেচা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। এ কারণে সিলেট, চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগে চামড়া কেনা নিয়ে শেষ পর্যন্ত শঙ্কা রয়ে গেছে। এসব এলাকায় প্রস্তুতি ঘাটতিও রয়েছে। তবে ঢাকা ও উত্তরাঞ্চলের চামড়া কেনার প্রস্তুতি ভাল রয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
দেশে চামড়া উৎপাদনের প্রায় ৬০ শতাংশ কোরবানির পশু থেকে পাওয়া যায়। কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে প্রতিবারই কিছু চামড়া নষ্ট হয়। গত দুই বছর চামড়া নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হন ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, বছরে বাংলাদেশ থেকে মোটামুটি ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১ দশমিক ২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া।
প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এবার কোরবানিতে এক কোটি ১৮ লাখ পশু কোরবানির যোগ্য বিবেচনা করা হচ্ছে। এর মধ্যে গরু-মহিষ ৪৫ লাখ এবং ছাগল ভেড়া ৭২ লাখ।
পুরনো বছরের বকেয়া, চামড়া নষ্টের আশঙ্কা
কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশক’জন ট্যানারি মালিকরা গত কয়েক বছরের পাওনা টাকা পরিশোধ করেননি। এতে আর্থিক সঙ্কটে পড়েছেন তারা। এর প্রভাব পড়তে পারে চামড়া কেনাবেচায়।
ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড রিটেইল স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নওয়াব আলী বলেন, গত বছরের পাওনা টাকা দিয়েছেন ট্যানারি মালিকরা। কিন্তু ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বকেয়া পাওনা কিছু ট্যানারি আংশিক দিয়েছে। আবার অনেক ট্যানারি টাকা দেয়নি। অর্থ ঘাটতির আংশিক সমাধান হওয়ায় এর প্রভাব পড়তে পারে।
বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিনের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে সমকাল।
তিনি সমকালকে বলেন, ‘দেশের ৩০ থেকে ৪০ টি ট্যানারি ৮০ ভাগ চামড়া কিনে প্রক্রিয়াজাত করছে। এসব ট্যানারির কাছে কোনো বকেয়া টাকা পাবেন না আড়তদাররা। তাছাড়া এবার বেশিরভাগ ট্যানারি বকেয়া টাকা দিয়েছে। দু’চারটি ট্যানারি হয়ত টাকা দিতে পারেনি। সব মিলিয়ে প্রস্তুতি ভালো রয়েছে। অনেক ট্যানারি আড়তদারদের চামড়া কিনতে অগ্রিম টাকা দিয়েছে। তাই সঙ্কট থাকবে না।’
চামড়া সংরক্ষণে লবণের ‘পর্যাপ্ত মজুদ’
কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আফতাব খান সমকালকে বলেন, এবার অত্যধিক গরম ও বৃষ্টির কারণে নষ্ট হতে পারে। এজন্য চামড়া কিনে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টার মধ্যে আড়তদারদের দিতে হবে। তা না হলে ৫ থেকে ৭ কেজি লবণ এই সময়ের মধ্যে লাগিয়ে রাখলে নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা হবে। পরে ভালো দাম পাওয়া যাবে।
তিনি জানান, কোরবানির ঈদের সময় পশুর চামড়ার সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে অবিক্রিত চামড়া প্রত্যেকের বাড়িতেই লবণ ছিটিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। এতে চামড়া নষ্ট হওয়ার হাত থেকে যেমন রক্ষা পাব, তেমনি বিক্রিতে দাম পাবে।
বিএফএলএলএফইএ ধারণা করছে, এবার কোরবানি ঈদে চামড়ায় ৮২ হাজার টন লবণ লাগবে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ১ লাখ টন লবন সবরাহ নিশ্চিত করা হচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্ত কাজী সাখাওয়াত হোসেন সমকালকে বলেন, এবার যাতে চামড়া নষ্ট না হয় এজন্য কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। সব জেলায় কর্মকর্তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করা হবে। তাছাড়া ইতোমধ্যে পর্যাপ্ত লবণ স্বাভাবিক দামে সরবরাহ নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘লবণ ছাড়া চামড়া যেন ঢাকায় না আসে সেজন্য ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বাইরের চামড়া ঢাকায় না আনতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
গরু বা মহিষের প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম ৪-৪৫ টাকা
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চামড়ার দর নির্ধারণ করে জানিয়েছে, ট্যানারিগুলো এবার ঢাকার লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরু বা মহিষের চামড়া কিনবে ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়। গত বছর এই দাম ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা।
ঢাকার বাইরে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরু বা মহিষের চামড়ার দাম হবে ৩৩ টাকা থেকে ৩৭ টাকা; যা গতবছর ২৮ থেকে ৩২ টাকা ছিল। এছাড়া সারাদেশে লবণযুক্ত খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৫ থেকে ১৭ টাকা, আর বকরির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সব মিলিয়ে এবার চামড়া বেশি দামে বিক্রি হবে- এমনটা আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ হিসাবে প্রতিটি গরু ও মহিষের ২০ থেকে ৩০ বর্গফুট চামড়ায় ৫ থেকে ৬ কেজি লবণ দিতে ৬০ থেকে ৭০ টাকা খরচ হবে।
ঢাকার চামড়া বড় বেশিরভাগই ৩০ বর্গফুট হয়। এ চামড়া ট্যানারি কিনবে ১৩৫০ টাকায়। লবণের দাম, শ্রমিকের মজুরি, পরিবহন খরচসহ মোট ১০০ থেকে দেড়শ টাকা খরচ হবে তাদের।
ঢাকার বাইরে থেকে বেশিরভাগই ছোট চামড়া আসে। ২০ বর্গফুট চামড়া লবণসহ ট্যানারি কিনবে ৮০০ টাকায়। এর থেকে ৩০০ টাকা মুনাফা ও ব্যয় ধরলেও ছোট চামড়া ৫০০ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা।