স্বাস্থ্য

শুরুতে শনাক্ত করা কঠিন এমন ৭টি ক্যানসার

তাড়াতাড়ি বা প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার শনাক্তকরণের জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টার অন্ত নেই। এর কারণ হচ্ছে- ক্যানসার যত তাড়াতাড়ি নির্ণয় করা যাবে, আরোগ্য লাভের সম্ভাব্য তত বেশি। কিন্তু সব ক্যানসার সহজে নির্ণয় করা যায় না।প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করা কঠিন এমন ৭টি ক্যানসার সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসার:
প্যানক্রিয়েটিক ক্যানসার বা অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসার হচ্ছে, একটি বিরল রোগ। প্যানক্রিয়েটিক ক্যানসার শনাক্তকরণ কঠিন হওয়ার কারণ হচ্ছে- এটি অভ্যন্তরীণ, প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যথাহীন এবং সাধারণত এমন কিছুর সঙ্গে সংযুক্ত নয় যা উপসর্গ সৃষ্টি বা প্রকাশ করতে পারে। ব্যতিক্রম হচ্ছে- যদি এটি বাইল ডাক্ট বা পিত্তনালীর নিকটে হয়ে থাকে, তাহলে ব্লকেজ হবে এবং প্রাথমিক পর্যায়ের উপসর্গ হিসেবে জন্ডিস দেখা দেবে। অল্পসংখ্যক সৌভাগ্যবানের ক্ষেত্রে এ ক্যানসারের চিকিৎসা হচ্ছে খুব বড় অপারেশন। যাদের ক্যানসার অগ্রসর বা চূড়ান্ত পর্যায়ে ধরা পড়ে তাদের চিকিৎসা প্রধাণত কেমোথেরাপি এবং অনেকেই সাময়িকভাবে উপশম লাভ করে।

কিডনি ক্যানসার:
কিডনি ক্যানসার শনাক্ত করা কঠিন হতে পারে, কারণ রোগীরা সাধারণত উপসর্গ দেখা না দেওয়া পর্যন্ত টেস্ট করে না। উপসর্গসমূহের মধ্যে পিঠের নিম্নভাগে ব্যথা, দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি, অনাকাঙ্ক্ষিত ওজন হ্রাস এবং প্রস্রাবে রক্ত উল্লেখযোগ্য।কিডনির অবস্থান শরীরের খুব গভীরে হওয়ার কারণে বার্ষিক শারীরিক পরীক্ষায় ক্ষুদ্র কিডনি টিউমার দেখা নাও যেতে পারে।এছাড়া যেসব লোকের কিডনি ক্যানসারের বর্ধিত ঝুঁকি নেই তাদের ক্ষেত্রে কিডনি ক্যানসারের জন্য কোনো রিকমন্ডেড স্ক্রিনিং টেস্ট নেই। যেসব রোগীর বংশগত শারীরিক দশা যেমন- ভন হিপেল-লিনডাউ সিন্ড্রোম (ভিএইচএল), হেরেডিটারি প্যাপিলারি রেনাল সেল কার্সিনোমা (এইচপিআরসিসি) এবং বার্ট-হগ-ডিউব সিন্ড্রোম (বিএইচডি) আছে, তাদের কিডনি ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এসব রোগীদের কিডনি টিউমার আছে কিনা দেখার জন্য ডাক্তাররা নিয়মিত ইমেজিং টেস্ট যেমন- কম্পিউটারাইজড টমোগ্রাফি (সিটি) অথবা ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং (এমআরআই) রিকমেন্ড করতে পারেন।

নন-স্মল সেল লাং ক্যানসার:
তিন-চতুর্থাংশ লাং ক্যানসার বা ফুসফুস ক্যানসার নির্ণীত হয় তা ছড়িয়ে পড়ার পর এবং প্রায়ক্ষেত্রে রোগীরা ঔপসর্গিক হয় না যতক্ষণ পর্যন্ত এ ক্যানসার কাশি, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট ও অন্যান্য উপসর্গ সৃষ্টি করার মতো বিকশিত না হয়। ফুসফুস ক্যানসারের সর্বাধিক কমন ধরন হচ্ছে নন-স্মল সেল লাং ক্যানসার (এনএসসিএল) এবং এটি প্রাথমিক পর্যায়ে শণাক্ত করা কঠিন- কারণ হচ্ছে প্রায়ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে ফুসফুস ক্যানসারের উপসর্গ দেখা দেয় না এবং তা বুকের এক্স-রে দিয়ে শনাক্ত করা যায় না। পজিট্রন এমিশন টমোগ্রাফি (পিইটি) এবং সিটি স্ক্যান ফুসফুস ক্যানসার নির্ণয়ে সহায়ক হতে পারে। একজন ডাক্তার ফুসফুস নিঃসরণ (ফুসফুসের আশপাশের তরল) থেকে ক্যানসার কোষ সংগ্রহ করতে পারেন অথবা নিশ্চিত ডায়াগনোসিসের জন্য বায়োপসি করতে পারেন, যা সাধারণত ফুসফুস ক্যানসারের অগ্রসর বা চূড়ান্ত পর্যায়ে করা হয়ে থাকে। নন-স্মল সেল লাং ক্যানসারে সার্ভাইভাল রেট বা বেঁচে থাকার হার খুব কম যদি তা অগ্রসর বা চূড়ান্ত পর্যায়ে ধরা পড়ে, তাই ধূমপানের দীর্ঘ ইতিহাস থাকা লোকদের প্রাথমিক পর্যায় বা অধিক নিরাময়যোগ্য পর্যায়ে ফুসফুস ক্যানসার শনাক্তকরণের জন্য সিটি স্ক্রিনিং করানোর জন্য ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা উচিত এবং সেই সঙ্গে ধূমপান ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে সর্বোত্তম করণীয়।

ডিম্বাশয়ের ক্যানসার:
নারীদের ক্যানসারের মধ্যে ৩ শতাংশ ক্যানসার হচ্ছে ওভারিয়ান ক্যানসার বা ডিম্বাশয়ের ক্যানসার এবং এটি হচ্ছে পঞ্চম প্রাণঘাতী ক্যানসার, যা নারীদের অন্যান্য রিপ্রোডাক্টিভ ক্যানসারের তুলনায় অধিক মৃত্যু ঘটানোর জন্য দায়ী। ক্যানসার ডট অর্গ অনুসারে, অন্যান্য ক্যানসারের মতো এ ক্যানসার যত তাড়াতাড়ি ডায়াগনোসিস হবে, তত বেশি নিরাময় সম্ভব হবে, কিন্তু মাত্র ২০ শতাংশ ওভারিয়ান ক্যানসার প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে। ওভারিয়ান ক্যানসার ধরা না পড়ার প্রধান কারণ হচ্ছে পেটের গহ্বরের আকার ও ফাঁপ এবং সত্য হচ্ছে- প্রাথমিক পর্যায়ের ওভারিয়ান ক্যানসারের কোনো উপসর্গ দেখা যায় না।এটি প্রায়ক্ষেত্রে তৃতীয় বা চতুর্থ পর্যায়ে ধরা পড়ে।

সারকোমা:
শরীরের টিস্যুর (যেমন- ফ্যাট, মাসল, ডিপ স্কিন টিস্যু, বোন অথবা কার্টিলেজ) এসব টিউমার প্রাথমিক পর্যায়ের উপসর্গ প্রকাশ করে না। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে সারকোমা হচ্ছে, ক্যানসারের খুব বিরল একটি ধরন এবং এটি হচ্ছে তাদের মধ্যে সকল ধরনের ক্যানসারের ১ শতাংশ। এ ক্যানসার শিশুদের ক্ষেত্রে অত্যধিক কমন। সকল প্রকার শিশু ক্যানসারের মধ্যে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হচ্ছে সারকোমা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সারকোমা সারফেসের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়, যে কারণে ঔপসর্গিক হওয়ার আগেই সারকোমা টিউমার বড় হতে পারে।এটি শনাক্ত করা যায় এমন ব্লাড মার্কারও প্রকাশ করে না এবং এটি সাধারণত উচ্চ ঝুঁকিমুক্ত লোকদের ক্ষেত্রে আনকমন- যা তাদেরকে স্ক্রিনিংয়ের জন্য অনাদর্শ করে তোলে। সারকোমার একমাত্র ডায়াগনস্টিক টুল হচ্ছে বায়োপসি এবং চিকিৎসা হচ্ছে সাধারণত সার্জারি (যদি সম্ভব হয়) এবং বর্তমানে প্রচলিত সিস্টেমিক থেরাপি খুব একটা কার্যকরী নয়।

ব্রেইন ক্যানসার:
রোগীর লক্ষণ ও উপসর্গের কারণে প্রায়ক্ষেত্রে ব্রেইন ক্যানসার এবং স্পাইনাল কর্ড টিউমার ধরা পড়ে, কিন্তু প্রায়সময় এসব নির্ণীত হয় ক্যানসারের অগ্রসর বা চূড়ান্ত পর্যায়ে।যদি ঐচ্ছিক গতিবিধি বা নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণকারী মস্তিষ্কের অংশ মোটর কর্টেক্সে টিউমার আবির্ভূত হয়, তাহলে বাহু বা পায়ে দুর্বলতার মতো উল্লেখযোগ্য ঘাটতির সৃষ্টি হতে পারে।কিন্তু এসব টিউমার পার্শ্ববর্তী অংশে আবির্ভূত হতে পারে, যেখানে তারা কিছুটা অস্পষ্ট উপসর্গ সৃষ্টি করতে পারে, যেমন- ফাইন মোটর টাস্ক বা হালকা গতিদায়ক কাজ সম্পাদনের সময় হাতে আনাড়িপনা এবং কথা বলতে সমস্যা। রোগীর ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে ছোটখাটো পরিবর্তন দেখা দিতে পারে যা শুধুমাত্র তাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্যরা ধরতে পারে। ব্রেইন টিউমার শনাক্তকরণের জন্য সর্বাধিক কমন উপসর্গ হচ্ছে মাথাব্যথা এবং লোকজনের মাঝে মাথাব্যথা এতই কমন যে, রোগী ও কিছু প্রাইমারি কেয়ার ফিজিশিয়ানরাও একে অবহেলা করে থাকে। সংক্ষিপ্ত পরিসরে এমআরআই বা সিটি স্ক্যানের মতো মস্তিষ্কের ইমেজিং স্টাডি ছাড়া ব্রেইন ক্যানসারের জন্য কোনো ক্যানসার স্ক্রিনিং নেই এবং এ ক্যানসারে আরোগ্যলাভের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।বর্তমানে কোনো নিরাময় না থাকলেও নিউরো-অনকোলজি টিমের লক্ষ্য হচ্ছে যত বেশি সময় সম্ভব নিউরোলজিক্যাল ফাংশন চালু রাখা এবং এ ক্যানসারের বিকাশ নিয়ন্ত্রণ করা।

লিভার ক্যানসার:
অগ্রসর বা চূড়ান্ত পর্যায়ে না যাওয়া পর্যন্ত লিভার ক্যানসারের উপসর্গ প্রকাশ পায় না বলে এ ক্যানসারও শনাক্ত করা কঠিন। যদি টিউমার ছোট হয়, তাহলে এটি বিশেষ করে শারীরিক পরীক্ষায় শনাক্ত করা কঠিন, কারণ এ অর্গানের বেশিরভাগ অংশ ডান পাঁজরের খাঁচা দ্বারা আবৃত থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ অর্গানের সর্বত্র টিউমার ছড়িয়ে পড়তে পারে। ঝুঁকিমুক্ত লোকদের ক্ষেত্রে লিভার ক্যানসারের জন্য রিকমন্ডেড ক্যানসার স্ক্রিনিং টেস্ট না থাকলেও আপনার ডাক্তার আপনাকে টেস্ট রিকমেন্ড করতে পারেন- যদি আপনার এ রোগের পারিবারিক ইতিহাস থাকে অথবা পূর্বে হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস নির্ণীত হয়ে থাকে। অ্যালকোহলে আসক্ত রোগীদের দীর্ঘস্থায়ী সিরোসিস অথবা লিভার ডিজিজের পর লিভার ক্যানসার ডেভেলপ হতে পারে।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button