নকশা অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা জাহাজ চলছে সাগরে
‘এমভি লা মেরিন-২’ জাহাজ নির্মাণের জন্য নৌপরিবহন অধিদপ্তরে আবেদন করেছেন হোমল্যান্ড শিপিং লাইনের মালিক মো. জাকির হোসেন। জাহাজের নকশা অনুমোদন হয়নি বলে খোদ জাকির হোসেনই স্বীকার করেছেন। অর্থাৎ জাহাজ এখনো তৈরি হওয়ার কথা নয়; কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো- জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে পণ্য পরিবহন করছে। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। কোস্টগার্ডের জালে ধরা পড়ার পর জাহাজ আটক করে মামলা হয়েছে মালিকের বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, জাহাজ নির্মাণের নকশা জমা দিয়েই সাগরে পণ্য পরিবহন শুরু করে এমভি লা মেরিন-২। জাহাজের নকল সনদ তৈরি করে সাগরে নামানো হয়। ওই জাহাজে থাকা মাস্টারের সনদও জাল পাওয়া গেছে। নৌপরিবহন অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল করে সার্ভে সনদ তৈরি করে তা প্রদর্শন করা হয়েছে।
মালিক জাকির হোসেন জালিয়াতির কথা স্বীকার না করলেও প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ রয়েছে বলে জানিয়েছে নৌপরিবহন অধিদপ্তর ও নৌ-বাণিজ্য দপ্তর।
সূত্র জানায়, নৌপরিবহন অধিদপ্তরের একটি জালিয়াত চক্রকে ম্যানেজ করে জাল সার্ভে সনদ তৈরি করেছেন জাকির। সরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে ফাঁকি দিতেই নকশা অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা জাহাজের নকল সনদ দেওয়া হয়েছে। কোনো ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে জাহাজটি চলছিল। এ ধরনের মিথ্যা তথ্যে চলাচলকারী জাহাজের জন্যই বন্দর চ্যানেলে দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে বন্দর চ্যানেল।
সর্বশেষ গতকাল দুপরে একটি বাংকার বার্জ (আউটাসে আসা বিদেশি জাহাজে তেল সরবরাহকারী) ডুবে গেছে। জাহাজে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত না করায় উত্তাল বঙ্গোপসাগরের পতেঙ্গা এলাকায় ডুবে যায়। নাবিকরা নিরাপদে ফিরেছেন। বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে সেটি নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি ডুবো জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা লেগে দুটি লাইটার জাহাজ ডুবে গেছে। ফলে যে কোনো সময় দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।
নৌ-বাণিজ্য দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ ধরনের দুর্ঘটনার কারণে বন্দর চ্যানেল ঝুঁকিতে পড়ার পাশাপাশি বহির্বিশে^ বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণœ হয়। বর্তমানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মালবাহী কার্গো ভ্যাসেল, ট্যাংকার, ট্রলার, ফিশিং বোট, কার্গো বোট নকল সনদ (রেজিস্ট্রেশন সনদ ও বার্ষিক সার্ভে সনদ) নিয়ে চলাচল করছে। নীরিক্ষায় দেখা ওঠে এসেছে, এসব নৌযানে জাল সনদে কর্মরত আছেন বহু মাস্টার, চালক ও স্কিপার। এ ছাড়া অনিবন্ধিত বাল্ক হেড দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে মালামাল পরিবহন হচ্ছে।
নৌ-বাণিজ্য অধিদপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আমাদের সময়কে বলেন, জাল সদন ও অনিবন্ধিত নৌযান চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেল, জান-মাল ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে, এতে বহির্বিশে^ বন্দরের সুমান ক্ষুণœ হয়েছে। সরকার হারাচ্ছে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব। জাল সনদ ও বাল্কহেড দিয়ে পণ্য পরিবহন বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে একটি জাহাজ আটক করে মামলা দেওয়া হয়েছে। এসব অনিয়ম বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নকল সার্ভে সনদে জাহাজ চলাচল করায় এমভি লা মেরিন-২-এর মালিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন অভ্যন্তরীণ জাহাজ পরিদর্শনালয়ের পরিদর্শক আবু জাফর মিয়া। নৌ আদালতে করা মামলায় অভ্যন্তরীণ নৌ চালাচল আইনের ৩৩, ৫৪(ক), ৫৬ ও ৬৬ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
এদিকে মামলা ও জাহাজের বিষয়ে তিন দিন ধরে যোগাযোগ করা হয়েছে বাদী জাকির হোসেনের সঙ্গে। তিনি প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে সময়ক্ষেপণের পাশাপাশি মামলার এজহার দিতে অনীহা প্রকাশ করেছেন। মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এমভি লা মেরিন-২ জাহাজের মালিক অভিযুক্ত জাকির হোসেন আজাদ সনদ জালিয়াতির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তার দাবি, নকল সনদ সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না। জাহাজাটির নাম ও নকশার জন্য আবেদন করা হয়েছে। নামের অনুমোদন পেলেও নকশা এখনো অনুমোদন হয়নি। জাহাজ আটকের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘আমি কিছু জাানি না।’ জাহাজ ও নাবিকের নকল সনদের প্রয়োজনীয় দলিলাদি আমাদের সময়ের হাতে রয়েছে।