জাতীয়

বারবার কেন পদ্মা সেতুতে ফেরির ধাক্কা

পদ্মা সেতুর পিলারে বারবার ফেরির ধাক্কার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নৌপরিবহন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এ সেতুর একটি পিলার থেকে আরেকটির দূরত্ব ১৫০ মিটার হওয়া সত্ত্বেও মাত্র এক মাসের মধ্যে তিনবার ফেরির ধাক্কার ঘটনা রহস্যজনক। বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে চালকের অদক্ষতা ও অসতর্কতার কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। সেতুর পিলারের সঙ্গে ফেরির সংঘর্ষের ঘটনায় বিব্রত ও দুঃখ প্রকাশ করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়।
৯ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টার দিকে সেতুর ১০ নম্বর পিলারে ধাক্কা দেয় রো রো ফেরি বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর। ফেরিটি সঠিকভাবে পরিচালনায় ব্যর্থ হওয়ায় ওই ফেরির ভারপ্রাপ্ত মাস্টার মো. দেলোয়ারুল ইসলাম এবং হুইল সুকানি মো. আবুল কালাম আজাদকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে বিআইডব্লিউটিসি। এর আগে ২৩ জুলাই পদ্মা সেতুর ১৭ নম্বর পিলারের সঙ্গে শাহজালাল নামে একটি রো রো ফেরি ধাক্কা লেগেছিল। তেল খরচ কমাতে  সংক্ষিপ্ত পথে চলতে গিয়ে এ ঘটনা ঘটেছিল বলে তখন অভিযোগ ওঠে। এর মাত্র তিন দিন আগে রো রো ফেরি শাহ মখদুম পদ্মা সেতুর ১৬ নম্বর পিলারে ধাক্কা দেয়। বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে আসার পর এভাবে বারবার সেতুর পিলারে ফেরির ধাক্কা লাগার ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা নাকি উদ্দেশ্যমূলক- এমন প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে।
পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, সেতুতে বারবার ধাক্কা লাগার ঘটনাটি রহস্যজনক লাগছে। কারণ সেতুর একটা পিলার থেকে অন্য পিলারের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার বা ৪৯২ ফুট। আর যমুনা সেতুর একটা পিলার থেকে অন্য পিলারের দৈর্ঘ্য ১০০ ফুট। তারপরও যমুনা সেতুতে কোনো নৌযানের ধাক্কা লাগে না। গোমতী সেতুর নিচ দিয়ে বিদেশি জাহাজ চলাচল করে তারপরও ধাক্কা লাগে না। তাহলে কেন পদ্মা সেতুর পিলারে ফেরির বারবার ধাক্কা লাগছে। এ জন্য অদক্ষ চালক অথবা ফেরির ফিটনেস নেই বলে মনে করেন তিনি। প্রকল্প পরিচালক বলেন, বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের জানানো হয়েছে। আমরা মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের অবগত করেছি। ফেরি অনেক ছোট তাই স্বাভাবিকভাবে সেতুর পিলারে ফেরির ধাক্কা লাগার কথা নয়।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) একাধিক কর্মকর্তা বলেন, চালক ও সুকানির অসতর্কতার কারণে এমন ঘটনা ঘটছে। তা ছাড়া পদ্মা নদীতে তীব্র স্রোতের টানে অনেক সময় ফেরি নিয়ন্ত্রণে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই রুটে অনেক পুরনো ফেরিও চলে, যেগুলোর যেকোনো যন্ত্রাংশ যেকোনো সময় বিকল হয়ে ফেরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া ঘাটের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মোহাম্মদ ফয়সাল গণমাধ্যমকে জানান, নানা কারণেই ফেরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। অনেক সময় ফেরির ইঞ্জিন বা অন্য কোনো যন্ত্র হঠাৎ বিকল হয়ে পড়তে পারে।
গত ২৩ জুলাই এর দুর্ঘটনার জন্য ফেরির মাস্টার আব্দুর রহমান খান এবং সুকানি সাইফুল ইসলামকে দায়ী করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যানের কাছে। মাস্টার ও সুকানির ‘অসতর্কতার কারণেই’ ফেরি শাহজালাল পদ্মা সেতুর পিলারে ধাক্কা খেয়েছিল বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক বিআইডব্লিউটিসির পরিচালক (বাণিজ্য) এসএম আশিকুজ্জামান বলেন, পদ্মা সেতুর পিলারে ধাক্কা লেগেছে চালকের অসতর্কতায়। এখানে মাস্টার ও সুকানি দায়ী। তিনি বলেন, স্রোতের অনুকূলে কম গতিতে চালাতে গিয়ে চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে ফেরিটি সেতুর পিলারে ধাক্কা দেয়।
ফেরি শাহজালালের মাস্টার আব্দুর রহমান ওই সময় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ইলেকট্রনিক সার্কিট ব্রেকার পড়ে যাওয়ায় স্টিয়ারিং বিকল হয়ে যায়। সেটা দ্রুত ঠিক করতে পারলেও প্রবল স্রোতে ফেরির সমানের অংশ পদ্মা সেতুর খুঁটির সঙ্গে ধাক্কা খায়। আঘাত পানির লেভেলের নিচে হলে ফেরি ডুবে যেত পারত। যাত্রীরা ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে।
ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে তদন্ত কমিটি তিনটি সুপারিশ করেছিল বলে জানান তদন্ত কমিটির প্রধান এসএম আশিকুজ্জামান। প্রথমটি হচ্ছে পদ্মা সেতুকে এড়িয়ে চলতে শিমুলিয়া ঘাট পুরনো মাওয়া ঘাটে অথবা বাংলাবাজার ঘাট শরীয়তপুরের পুরনো মাঝিকান্দি ঘাটে স্থানান্তর; দ্বিতীয়টি হচ্ছে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ঘাটে চলাচলকারী দুর্বল ফেরি সরিয়ে স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিতে সক্ষম দ্রুতগতির ফেরি চালু; তৃতীয়টি হচ্ছে পদ্মা সেতুর পাইল ক্যাপে ফেন্ডার (টায়ারের মতো রাবার) স্থাপন করা।
নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, ২৩ জুলাইয়ের ঘটনার তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে ৯ আগস্টে ফেরির ধাক্কার ঘটনা ঘটত না। তিনি বলেন, বারবার পদ্মা সেতুর পিলারে ফেরির আঘাত অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত। এ জন্য শুধু ফেরির মাস্টার ও ড্রাইভার দায়ীÑ তা বলা যাবে না। নিশ্চয়ই এসব নৌযানের অপারেশনাল ফল্ট আছে। তবে সব দায় তাদের নয়। পদ্মা সেতু রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বৃহত্তর স্থাপনা। শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌপথসহ সংশ্লিষ্ট এলাকা দিয়ে চলাচলরত সব ধরনের নৌযানের ওপর বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের কঠোর তদারকির প্রয়োজন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফিলতি রয়েছে বলে মনে হয়। আশীষ কুমার দে আরও বলেন, ফেরিসহ সব ধরনের মাস্টার ও ড্রাইভারদের দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের দরকার। এ দায়িত্ব নৌ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা নৌপরিবহন অধিদফতরের। কিন্তু তারাও যথাযথ দায়িত্ব পালন করে বলে দৃশ্যমান হয় না।
নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, পদ্মা সেতু আমাদের মর্যাদার স্থাপনা; আত্মসম্মানের অনুভূতি। এ সেতুর পিলারের সঙ্গে ফেরির সংঘর্ষের ঘটনায় আমরা বিব্রত ও দুঃখিত। এটি আমাদের জন্য উৎকণ্ঠার বিষয়। পদ্মা সেতুতে আঘাত মানে; আমাদের হৃদয়ের মধ্যে আঘাত। বারবার হৃদয় ক্ষত হোক, সেটা চাই না। পদ্মা সেতু আমাদের চ্যালেঞ্জ, মান-মর্যাদার স্থাপনা।
পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন : এদিকে নির্মাণাধীন পদ্মা বহুমুখী সেতুর ১০ নম্বর পিলারের সঙ্গে ‘রো রো ফেরি বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর’-এর ধাক্কা লাগার ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি)। কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যানের নিকট রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। বিআইডব্লিউটিসির পরিচালক (কারিগরি) মো. রাশেদুল ইসলাম কমিটির আহ্বায়ক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেনÑ বিআইডব্লিউটিসির জিএম (মেরিন) ক্যাপ্টেন মুহাম্মদ হাসেমুর রহমান চৌধুরী, বিআইডব্লিউটিএ’র পরিচালক (নৌ সংরক্ষণ ও পরিচালন) এম শাহজাহান, এজিএম (ইঞ্জিনিয়ারিং) মো. রুবেলুজ্জামান এবং এজিএম (মেরিন) আহমেদ আলী।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button