জাতীয়

রেকর্ড উৎপাদনের বছরে চালের সর্বোচ্চ দাম

করোনা মহামারির পাশাপাশি নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও এ বছর বোরোর রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন হয়েছে। ইন্দোনেশিয়াকে টপকে বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় চাল উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে জায়গা করে নিতে যাচ্ছে। কিন্তু বছর বছর চালের উৎপাদন বাড়লেও ভোক্তা পর্যায়ে দাম কমছে না, বরং অন্য সময়ের চেয়ে দাম এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে এবার চালের দাম বেড়েছে গড়ে ১২ শতাংশ। খোদ সরকারি হিসাব অনুযায়ী, গত জুন মাস থেকে শুক্রবার পর্যন্ত চালের দাম প্রায় ১০ শতাংশ বেড়েছে।

নিম্ন আয়ের মানুষের বেশি চাহিদা মোটা চালের। সেই চালের দামও এখন ৫০ টাকা কেজি। ফলে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে সরকার। সংকট কাটাতে বেসরকারিভাবে ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক্কে ১০ লাখ টন সেদ্ধ চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

চলতি মাসের শুরুতে খাদ্যশস্যের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অনলাইনে বৈঠক করে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এতে রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদনে চালের দাম না কমায় মন্ত্রী, সচিবসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা অস্বস্তি প্রকাশ করেন।

গতকাল শনিবার রাজধানীর মিরপুর-১, মোম্মদপুর টাউন হল, আগারগাঁও বাজার ও কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা যায়, খুচরায় প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা। এসব বাজারের বেশিরভাগ দোকানি গুটি স্বর্ণা মোটা চাল ৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন। দু’সপ্তাহ আগেও এ চাল ৪৪ থেকে ৪৮ টাকায় বিক্রি করেছেন। গত বছর বোরো মৌসুমের এই সময়ে এ চাল ৪০ থেকে ৪৪ টাকা ছিল। এক বছরের ব্যবধানে একই সময়ে কেজিতে ৬ থেকে ৮ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে। শুধু মোটা চাল নয়, মাঝারি ও সরু চালের দামও বেড়েছে। এখন সরু চালের মধ্যে মিনিকেট ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা; আর নাজিরশাইল ৬৮ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আগে এই চালের দাম ছিল যথাক্রমে মিনিকেট ৫৬ থেকে ৬০ টাকা এবং নাজিরশাইল ৬২ থেকে ৬৫ টাকা। এ ছাড়া মাঝারি চাল বিআর-২৮ ও লতা বিক্রি হচ্ছে ৫৩ থেকে ৫৬ টাকা, যা আগে ছিল ৪৮ থেকে ৫০ টাকা।

মিরপুর-১ নম্বর আড়তের চাল বিক্রেতা শফিকুর রহমান সমকালকে বলেন, চালের দাম এখন অনেক বেশি। এই দাম প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে বাড়তি।

কারওয়ান বাজারের হাজি রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী মাঈনুদ্দিন মানিক সমকালকে বলেন, এখন মিলগুলোতে পর্যাপ্ত ধান রয়েছে। এখন দাম বৃদ্ধির কথা নয়। অথচ এই সময়ে অন্য যে কোনো বছরের চেয়ে দামে রেকর্ড গড়েছে।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, পর্যাপ্ত উৎপাদনের পরও বাজারে চালের দাম ঊর্ধ্বগতি। অবৈধভাবে ব্যবসা করেন এম মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে ধান মজুদ আছে। যদি বেসরকারিভাবে নন-বাসমতি, সেদ্ধ-আতাপ সরু চাল আমদানি করা হয় তাহলে বাজার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসবে।

খাদ্য সচিব ড. নাজমানারা খানুম বলেন, ছয় লাখ ৫০ হাজার টন ধান, ১০ লাখ টন সেদ্ধ চাল এবং এক লাখ টন আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৪০ শতাংশ ধান ও ৫৭ শতাংশ চাল সংগ্রহ হয়েছে। আগামী নভেম্বর পর্যন্ত স্বাভাবিক বিলি বিতরণে প্রায় ৯ লাখ টন চাল লাগবে। নীতিমালা অনুযায়ী ১০ লাখ টন মজুদ রাখতে হয়। এ ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের মাধ্যমে প্রায় পাঁচ লাখ টন আর বৈদেশিক সংগ্রহের মধ্যে প্রায় পাঁচ লাখ টন সংগ্রহ হবে, যা বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত নয়। কৃষককে ধানের ন্যায্যমূল্য প্রদানের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি বাড়াতে হবে।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, গত এক বছরের চালের দাম লক্ষ্য করলে দেখা যায়, চলতি মাসে গড়ে চালের দাম ১০% বেড়েছে। মধ্যস্বত্বভোগীর কাছে কী পরিমাণ মজুদ আছে সে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করার জন্য সব জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন হয়েছে। অবৈধ মজুদ থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সব জেলায় চিঠি পাঠানো হয়েছে।

কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সরকারের গুদামে যখন চাল থাকে না তখনই ব্যবসায়ীরা বাজার অস্থিতিশীল করেন। যারা চুক্তি অনুযায়ী চাল দেননি, তাদের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা এবং কালো তালিকাভুক্ত করতে হবে।

বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলীর ভাষ্য, গত মাসের শেষভাগ থেকে মিল পর্যায়ে চালের দাম বাড়তে শুরু করে। এর বড় কারণ ভরা মৌসুম থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ধানের দাম মণপ্রতি গড়ে ৩০০ টাকা বেড়েছে। এ কারণে চালের দাম বেড়েছে।

তিনি বলেন, দেশে এবার বাম্পার ফলনের রেকর্ড গড়েছে। এখন বিভিন্ন মহাজনের কাছে অনেক ধান মজুদ রয়েছে। ধানের দাম কমলে বাজারে চালের দামও কমবে।

রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, এক মাসের ব্যবধানে মোটা চালের দাম ৪ শতাংশ এবং সরু ও মাঝারি চাল প্রায় ২ শতাংশ বেড়েছে। তবে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে সরু ও মাঝারি চাল ১২ শতাংশ ও মোটা চাল ১৩ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বাজারদরের তথ্য অনুযায়ী, সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি বাজারে সব ধরনের চালের দাম প্রায় ২ শতাংশ বেড়েছে। তবে খুচরা বাজারে অপরিবর্তিত আছে।

বিশ্ববাজারে চালের দাম সপ্তাহের ব্যবধানে ২ থেকে ৫ শতাংশ কমেছে। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন চাল ৩৬৩ ডলার থেকে ৪১০ ডলার। এ হিসাবে প্রতি কেজি চালের দাম পড়ছে ৩০ টাকা থেকে ৩৫ টাকা। এই চাল দেশে আনার পর প্রতি কেজির দাম পড়বে ৩৩ টাকা ৪৮ পয়সা থেকে ৪০ টাকা। অথচ দেশের বাজারে মোটা চালের দাম বিশ্ববাজারের চেয়ে কেজিতে ১০ টাকা বেশি। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে রপ্তানি চালের মূল্য প্রতি কেজি ৩০ টাকা ৮০ পয়সা। এ হিসাবে দেশের বাজারে কেজিতে মোটা চালের দাম ২০ টাকা ও সরু চালের ৪০ টাকা বেশি।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত দেশে চালের চাহিদা মিটিয়ে আরও ৩০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। দেশে প্রতি মাসে চালের চাহিদা রয়েছে ২০ লাখ ২৮ হাজার টন। সেই হিসাবে বছরে দেশে চালের চাহিদা প্রায় দুই কোটি ৪৩ লাখ ৩৬ হাজার টন।

কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এবার বোরোতে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই কোটি পাঁচ লাখ ৮১ হাজার ৩০০ টন। উৎপাদন হয়েছে দুই কোটি আট লাখ ৮৫ হাজার ২৬২ টন, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে তিন লাখ তিন হাজার ৯৬২ টন বেশি। একক কোনো ফসলের এমন উৎপাদন এর আগে হয়নি।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্যমতে, ১৩ জুলাই পর্যন্ত ১২ লাখ ৮৭ হাজার টন মজুদ ছিল। বাম্পার ফলনেও খাদ্য মজুদ ও সংগ্রহ কম থাকায় এবার সরকার আমদানি বাড়াচ্ছে। অথচ গত কয়েক বছর বেসরকারিভাবে চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করে আসছিল সরকার।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ বলেন, সরকার যদি গুদামে পর্যাপ্ত পরিমাণ চাল সংগ্রহ করতে পারে, তাহলে মিলার কিংবা মজুদদার চক্র তৎপরতা দেখাতে পারে না। সরকার বাধ্য হয়ে বিদেশ থেকে চাল আমদানি করে মজুদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। এতে ওই চক্র বাজার ব্যবস্থায় তেমন প্রভাব খাটাতে পারবে না।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button