জাতীয়

বরাদ্দ দিলেও খরচ করতে পারেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়

দেশে মহামারি আকার ধারণ করেছে করোনাভাইরাস। প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে ২০০-২৫০ করোনা রোগী। আক্রান্ত হচ্ছে ১২-১৫ হাজার মানুষ। হাসপাতালে গিয়েও সেবা পাচ্ছেন না অনেক রোগী। স্বাস্থ্য খাতের এই দুর্বলতা অনেক আগের হলেও, দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর এর নাজুক চিত্রটি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এদিকে স্বাস্থ্য খাতে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বরাদ্দ দিলেও খরচ করতে পারছে না স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ও অধিদফতর। এ খাতে সক্ষমতার প্রচণ্ড ঘাটতি রয়েছে।
গত অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশা দূর করতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ৫৩টি প্রকল্পের আওতায় ১১ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও ৫ হাজার ৪২ কোটি টাকাই খরচ করতে পারেনি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। পুরো অর্থবছরে মাত্র ৬ হাজার ৯৩৭ কোটি খরচ হয়েছে। বরাদ্দের মাত্র ৫৭ শতাংশই ব্যয় করতে পেরেছে বিভাগটি। পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
এ ছাড়া গত অর্থবছরে স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে ১৫টি প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। যার মধ্যে খরচ হয়েছে ১ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। যা মোট বরাদ্দের ৮৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ। ব্যয় হয়নি ৩১০ কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলেছেন, শুধু বরাদ্দ বাড়িয়ে স্বাস্থ্য খাতের নাজুক অবস্থার পরিবর্তন হবে না। ব্যয়ের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থহীন ব্যয়ের অভিযোগগুলোরও সমাধান করতে হবে। এ খাতকে ঢেলে সাজাতে দীর্ঘমেয়াদে একটি রোডম্যাপ বা পথনকশা করার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
এডিপি বাস্তবায়ন কম হওয়ার বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, স্বাস্থ্য খাত সব সময়ই একটা দুর্বল খাত ছিল। এই দুর্বল খাতের ওপর গত বছর করোনার কারণে অনেক প্রকল্প পড়ে যায়। ফলে তাদের ব্যবস্থাপনায় সমস্যা হয়ে যায়।
অন্যদিকে এটা দুর্নীতিযুক্ত একটি খাত। এখানে বিভিন্ন লবিং আছে। তারা এখানে সুযোগ নেয়। ওষুধের সাপ্লাই, মেশিনারি এসব জায়গায় কোটা থাকে তারা একসেস করে। এসব কারণে বেশ প্রকিউরমেন্টও হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রকিউরমেন্ট বন্ধ হয়ে যায় বা দেরি হয়। এসব কারণে প্রকল্পগুলো দেরি হয়।
করোনা মহামারির মধ্যে স্বাস্থ্য বাজেটের দুর্বলতা নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞসহ সব মহল থেকে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবির পরিপ্রক্ষিতে গত অর্থবছরে একটি বড় স্বাস্থ্য বাজেট ঘোষণা করে সরকার, অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন মিলে যার আকার ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। এর বাইরে করোনা রোধে সুরক্ষাসামগ্রীসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনাকাটায় অতিরিক্ত ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, স্বাস্থ্য খাতের জন্য টাকার কোনো সমস্যা হবে না। যখন যা দরকার, তাই দেওয়া হবে। সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরের শুরু থেকেই ধীরগতি ছিল বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে। মাঝামাঝিতে এসে কিছুটা কাটছাঁট করে আকার ছোট করা হয় উন্নয়ন বাজেটের। শেষ দুই মাসে ব্যয় কিছুটা বাড়লেও বছরের শেষটাও আশাব্যঞ্জক হয়নি। ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে এডিপির ১৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে ৩৭ হাজার কোটি টাকার বেশি ফেরত গেছে।
আইএমইডির প্রতিবেদনে দেখা যায়, সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে উন্নয়নের পেছনে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬১১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। তবে বছরের মাঝামাঝিতে এসে তা কমিয়ে সংশোধিত এডিপি ২ লাখ ৯ হাজার ২৭২ কোটি টাকায় নামানো হয়। অথচ গত জুন শেষে তা থেকে খরচ হয়েছে ১ লাখ ৭২ হাজার ৫২ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে ৮২ দশমিক ২১ শতাংশে। বাকি ১৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ পেয়েও খরচ করতে পারেনি সরকারের ৫৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ।
বরাবরই দেখা যায়, বছরের শুরুতে কাজের তেমন গতি থাকে না। শেষ দিকে অর্থব্যয় লাফিয়ে বাড়ে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। শুধু জুনে এডিপির খরচ হয়েছে ৪৯ হাজার ৯২০ কোটি টাকা বা মোট এডিপির প্রায় ২৪ শতাংশ। এর আগে মে মাসে খরচ হয়েছিল ১৯ হাজার ৪০১ কোটি টাকা বা ৯.২৭ শতাংশ। এতে শেষ দুই মাসেই খরচ হয়েছে ৭০ হাজার ৩২১ কোটি টাকা বা ৩৩ শতাংশ। আর বাকি ১০ মাসে খরচ হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকা।
আইএমইডির প্রতিবেদন বলছে, এডিপি বাস্তবায়নে সবার চেয়ে এগিয়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। বিভাগটি মোট বরাদ্দের চেয়ে ৪ শতাংশ বেশি অর্থ খরচ করেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প বাস্তবায়ন হারও ১০১ দশমিক ২৯ শতাংশ। এ ছাড়া, কৃষি মন্ত্রণালয় ৯৭ দশমিক ৫২ শতাংশ, বিদ্যুৎ বিভাগ ৮৯ দশমিক ৭১ শতাংশ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে ৮৮ শতাংশ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রায় ৮৯ শতাংশ, দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ৮৯ শতাংশ, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ ৯৭ শতাংশ, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় প্রায় ৮৭ শতাংশ, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ৮৫ শতাংশ এবং সেতু বিভাগ প্রায় ৮৪ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন করেছে।
ব্যয়ের দিক দিয়ে সবার চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় ৩৫ দশমিক ৩২ শতাংশ। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ৪১ দশমিক ৮৭ শতাংশ, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ ৪৭ শতাংশ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ৪৮ শতাংশ, আইন ও বিচার বিভাগ ৫০ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন করতে পেরেছে।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button