রংপুর বিভাগসারাদেশ

এক বছরেও জমা পড়েনি ডিসি সুলতানাসহ তিন মেজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে মামলার প্রতিবেদন

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি : মাদকের অভিযোগে গত বছরের ১৩ মার্চ দিবাগত মধ্যরাতে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন কর্তৃক কুড়িগ্রামের সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে বাড়ি থেকে তুলে এনে নির্যাতনের ক্রিমিনাল মামলায় এক বছরেও জমা পড়েনি প্রতিদেন। এতে ন্যায় বিচার পাওয়া নিয়ে চরম হতাশায় ভুগছেন সাংবাদিক আরিফুল ও তার পরিবারের সদস্যরা।
জানা গেছে, কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের নামে জেলা প্রশাসনের একটি পুকুরের নামকরণ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের কুৃড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগানকে মধ্যরাতে ঘরের দরজা ভেঙ্গে তুলে আনা হয়। পরে মধ্যরাতেই মোবাইল কোর্টের নামে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে নির্যাতন ও মিথ্যা মামলায় কারাগারে প্রেরণ করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে আরিফুল ইসলাম গত বছরের ১৫ মার্চ জেল থেকে বেরিয়ে এসে হাসপাতালে চিকিৎিসাধীন অবস্থায় সাবেক জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনসহ তিন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল মামলা দায়ের করেন। কিন্তু মামলার প্রতিবেদন এক বছরেও জমা পড়েনি।
গত এক বছরে চারদফা তদন্ত প্রতিবেদন জমার তারিখ বদলালেও মামলাটি এখনও তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ। ফলে মামলার অগ্রগতি ও ন্যায় বিচার পাওয়া নিয়ে জনমনে সংশয় দেখা দিয়েছে।
এদিকে একবছরেও নিজের ওপর হওয়া নির্যাতন ও অন্যায়ের বিচার না পাওয়া নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন নির্যাতিত সাংবাদিক আরিফ। তিনি বলেন, ‘আসামিরা ক্ষমতাশালী হওয়ায় বিভিন্নভাবে মামলাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। মামলা মিমাংসার জন্য আমাকে বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। কিন্তু আমি আইনের আশ্রয় নিয়েছি ন্যায় বিচার পাওয়ার জন্য। শুধুমাত্র একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা কারণে আমার ওপর যে অন্যায় ও বর্বরোচিত নির্যাতন হয়েছে আমি তার বিচার চাই, অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’
কুড়িগ্রাম সদর থানা সূত্রে জানা গেছে, মামলার পর থেকে বদলিজনিত কারণে এ পর্যন্ত তিনবার তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে। মামলার তদন্ত কার্যক্রম এখনও চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহন করা হয়েছে। প্রাথমিক তদন্ত শেষে আদালতের নির্দেশে মামলার কেস ডাইরি (সিডি) আদালতে উপস্থাপনও করা হয়েছে। আগামী ২৬ এপ্রিল মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।
এব্যাপারে কুড়িগ্রাম সদর থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) গোলাম মর্তুজা বলেন, ‘সদ্য বিদায়ি তদন্ত কর্মকর্তার স্থলাভিষিক্ত হলেও এখনও মামলার ডকেট বুঝে পাইনি। ডকেট বুঝে পেলে মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে বলতে পারবো।’
তবে কুড়িগ্রাম সদর থানার অফিসার ইন চার্জ (ওসি) খান মো. শাহরিয়ার বলেন, ‘মামলাটির তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বেশ কিছু সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। আমরা কিছু সাক্ষিকে চিঠি দিয়ে ডেকেছি।’ তবে ব্যস্ত থাকার কথা জানিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি ওসি।
সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু জানান, পুলিশ প্রবিধানমালা ১৯৪৩ এর ২৬১ প্রবিধান অনুসারে বিরতিহীন ভাবে তদন্তকার্যক্রম চালালে সবচেয়ে জটিল মামলার তদন্ত শেষ করতেও ১৫ দিনের বেশি সময় লাগার কথা নয়। সাংবাদিক আরিফের মামলাটি সেরকম জটিল কোনও মামলা নয়। সুতরাং গত এক বছরেও এই মামলার প্রতিবেদন জমা না দেওয়াটা কোনও ভাবেই স্বাভাবিক নয়। আমরা প্রত্যাশা করি পুলিশ সবরকম প্রভাবমুক্ত থেকে আইনের শাসনের সার্থে দ্রুত এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে।
প্রসঙ্গত, কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের নামে জেলা প্রশাসনের একটি পুকুরের নামকরণ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে গত বছর ১৩ মার্চ দিবাগত মধ্যরাতে (১৪ মার্চ) সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানকে তার নিজ বাড়ি থেকে ঘরের দরজা ভেঙে তুলে নিয়ে যায় জেলা প্রশাসনের মোবাইল কোর্ট। এরপর তাকে এনকাউন্টারে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে জেলা শহরের ধরলা বিজ্রের পূর্ব পারে নেওয়া হয়। পরে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে বিবস্ত্র করে নির্মম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন ওই সময়ের আরডিসি নাজিম উদ্দীন, এনডিসি রাহাতুল ইসলাম ও মোবাইল কোর্টের নির্বাহী মেজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমাসহ জেলা প্রশাসনের কর্মচারীরা। পরে সাংবাদিক আরিফের কাছে আধা বোতল মদ ও দেড়শ’ গ্রাম গাঁজা পাওয়ার অভিযোগ এনে তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। মধ্যরাতে বাড়ি থেকে একজন সাংবাদিককে ধরে এনে সাজা দেওয়ার ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। গণমাধ্যমে এ ঘটনা ফলাও করে প্রচার হলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনায় পরদিন ঘটনাস্থলে যান অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) আবু তাহের মো. মাসুদ রানা। তার প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন, আরডিসি নাজিম উদ্দিন ও সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমা ও এসএম রাহাতুল ইসলামকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যার তদন্ত কাজ চলমান রয়েছে।
গত বছরের ১৫ মার্চ পরিবারের আবেদন ছাড়াই আরিফকে জামিনের ব্যবস্থা করে জেলা প্রশাসন। কারামুক্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তৎকালীন জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনসহ তিন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আরডিসি নাজিম উদ্দিন, সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমা ও এসএম রাহাতুল ইসলামসহ অজ্ঞাত ৩৫/ ৪০ জনের বিরুদ্ধে কুড়িগ্রাম সদর থানায় এজাহার দায়ের করেন সাংবাদিক আরিফ। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে ৩১ মার্চ সেই মামলা রেকর্ড করে কুড়িগ্রাম সদর থানা পুলিশ। মামলার নম্বর-২৪, জি আর নম্বর-৮৩/২০২০ (কুড়ি)।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button