খুলনা বিভাগসারাদেশ

মাদকের অভয়াশ্রমে রূপ নিয়েছে দৌলতদিয়া যৌনপল্লি

রাজবাড়ী প্রতিনিধি : প্রভাবশালী রাজনীতিক, পুলিশ প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে দৌলতদিয়া যৌনপল্লি এখন মাদকের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে। যৌনপল্লিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন প্রকার মাদকের অর্ধ-শতাধিক দোকান।
চা-মুড়ি, মুদি দোকানের মতো করেই এইসব মাদকের দোকান দিনের আলোতেই খোলা-মেলা ভাবে চলে। পুলিশ প্রশাসনের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় লাইন্সেস বিহীন মাদকের দোকান চালিয়ে যাচ্ছে প্রভাবশালীরা। গোটা পল্লী ঘুরে চারটি মাত্র দোকান মিললো যেগুলো লাইসেন্স নিয়ে পরিচালিত হয়।
রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়ায় পদ্মাপাড়ে গড়ে উঠেছে দেশের বৃহত্তম এই যৌনপল্লি। যেখানে ২১০০ যৌনকর্মী, ৩১৬ বাড়িওয়ালী ও দেড় হাজারের বেশি ছেলে-মেয়ে বাস করে।
শনিবার (২৮ নভেম্বর) সরেজমিনে কথা হচ্ছিলো দৌলতদিয়া যৌনপল্লির বাসিন্দাদের সঙ্গে। প্রথম দিকে মুখ খুলতে না চাইলেও কথায় কথায় বেরিয়ে আসে অনেক তথ্য। মুখ খুলতে না চাওয়ার পেছনে কারণ একটাই, ভয়। পল্লির ভিতরে ঘুরে ঘুরে বাংলা মদ ও গাঁজার পাশাপাশি, ফেনসিডিল, হেরোইন ও ইয়াবা বিক্রি করে একটি গ্রুপ। তাদেরকেও বড় অংকের চাঁদা মাসোহারা দিয়েই এই ব্যবসা চালাতে হয় বলে জানালেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই জানান, মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রভাবশালী একটি গ্রুপ নিয়মিত মাসোহারা নেয়। শেষ পর্যন্ত নামও বেরিয়ে এলো দু’য়েক জনের মুখ থেকে। তারা প্রতিটি মাদকের দোকান থেকে দিনে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা করে তুলে নেয়। এ থেকে হিসেব কষলে দৌলতদিয়া যৌন পল্লিতে মাদক ব্যবসায় চাঁদাবাজিই হয় মাসে ৪৫ লাখ টাকার বেশি।
মাদকের বাণিজ্যে এই পল্লিতে কোটি টাকার লগ্নি রয়েছে সে কথা জানিয়েছেন অনেকেই। গোয়ালন্দের এই নিষিদ্ধ পল্লিতে চারটি মাত্র বাংলামদের দোকান লাইন্সেস করা। কিন্তু প্রতিদিন এখানে বিক্রি হচ্ছে হাজার হাজার লিটার মদ, দাবি স্থানীয়দের। তাদের বক্তব্য, মাঝে মধ্যে লোকদেখানোভাবে দুই একটি চালান আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে আসল ব্যবসা থাকে ধরা ছোয়ার বাইরে।
পুলিশ নিজেও নিয়মিত মাসোহারা নিয়ে এসব দেখেও না দেখার ভান করে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। মোহন মোল্লা, শফি খন্দকার, নিজাম, তপু, সলেমান, মাজেদ, লালমিয়া, আশরাফ, নুরু, কুদ্দস মন্ডল, আজিজ প্রামানিক, স্থানীয় আওয়ামী-লীগ নেতা, ইউপি সদস্য ও যুবলীগ নেতা সহ অনেকেই এখানে মাদকের রমরমা বাণিজ্য করে যাচ্ছেন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেল, এখানে অবাধে যেকোন জায়গা দিয়ে মাদক প্রবেশ করছে দিনের আলোতেই। আশে-পাশের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা এবং এলাকার যুব সমাজ এতে আসক্ত হচ্ছে। এ কারনে এলাকায় প্রতিনিয়ত ছিনতাইয়ের মত ঘটনা ঘটছে বলেও অভিযোগ করেন তারা।
নাম গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে এখানকার স্থানীয় একজন  ইয়াবা ও ফেনসিডিল ব্যবসায়ী কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রথমে তিনি অস্বীকার করেন। পরে তিনি বলেন, “অনেকেই অনেক কথা বলবে। এ গুলো (মাদক) বাইরে থেকে যারা আসে তারাই নিয়ে আসে।” তাহলে আপনার নাম কেন সবাই বললো, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি আগে করতাম, এখন আর করি না।’
তবে পরে তিনি নিজেই টেলিফোন করে বলেন, “আমি আগে স্থানীয় হানিফ দেওয়ানের হয়ে কাজ করতাম, প্রতি দিন তিনি আমাকে ৩০০/৪০০ টাকা করে দিতেন। কিন্তু আমি ভেবে দেখলাম, যদি ধরা পড়ি তাহলেতো আমাকেই কারাগারে যেতে হবে। এমনতো না, আমি মাসে ৫০,০০০ টাকা কামাই করি।”
মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসোহারা আদায়কারীদের নেতা লাল মিয়ার কাছ থেকে এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিচয় পেয়ে তিনি উত্তেজিত কন্ঠে বলেন, “এর আগে কতো সাংবাদিকরাই লেইখ্যা কিছু করতে পারে নাই, আর আইছে সাংবাদিক।” পরে বেশ কয়েকবার তাকে টেলিফোনে চেষ্টা করলেও তিনি আর ফোন রিসিভ করেন নি।
পুলিশের বিষয়ে একজন বাংলা মদের ব্যবসায়ী বলেন, “পুলিশ মাঝে মাঝে আসে, তারাতো আর সবসময় থাকে না। এ কারনে আমাদের মতো লাইসেন্স বিহীন মাদক ব্যবসায়ীদের কোন সমস্যা হয় না।”
মাদক ব্যবসা সর্ম্পকে জানতে চাইলে গোয়ালন্দ ঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আব্দুল্লাহ আল তায়াবীর বলেন, “আমরা প্রায়ই ওখানে অভিযান চালাই। নিয়মিত অভিযান এবং এর বাইরে গোপন সংবাদ পেয়েও অভিযান চালাই। জুয়া খেলা বন্ধ করেছি, বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন প্রকার মাদক উদ্ধার করেছি। গ্রেফতারও করেছি অনেককেই।”
পুলিশের অভিযানে মাঝে মধ্যে কেউ কেউ গ্রেফতার হলেও পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। আবার নতুন উদ্যমে তারা শুরু করে মাদক ব্যবসা, এমন অভিযোগ স্থানীয়দের। আর খোদ ব্যবসায়ীরাই বলেছেন, প্রশাসনের সঙ্গে আপোস করেই তারা এ ব্যবসা করছেন।
এ প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ আল তায়াবীরকে প্রশ্ন করা হলে সরাসরি অস্বীকার করেন তিনি। বলেন, “প্রশ্নই ওঠে না। প্রশাসন কোনো অবস্থাতেই ওদের সঙ্গে আপোস করার মতো দুর্বল নয়।”

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Back to top button