স্বাস্থ্য

ভিটামিন ‘কে’ এর প্রয়োজনীতা

যখন পুষ্টির প্রসঙ্গ আসে তখন আমরা ভিটামিন কে এর কথা খুব একটা শুনি না, কিন্তু এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বা প্রয়োজনীয় ভিটামিন। ভিটামিন কে এর প্রধান ধরন দুইটি: ভিটামিন কে১ ও ভিটামিন কে২।

লস অ্যাঞ্জেলেসের রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ান এরিকা জুলসন বলেন, ‘ভিটামিন কে১ ব্লাট ক্লট বা রক্ত জমাটবদ্ধতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, অন্যদিকে ভিটামিন কে২ হাড়ের স্বাস্থ্য, কোষের গ্রোথ নিয়ন্ত্রণ ও ধমনীতে ক্যালসিফিকেশন (ক্যালসিয়াম জমে যাওয়া, যা হৃদরোগের অন্যতম অনুঘটক) প্রতিরোধের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’

একটি পুষ্টি বিষয়ক গবেষণায় পাওয়া যায়, প্রায় ৩১ শতাংশ সাধারণ প্রাপ্তবয়স্ক লোকের ভিটামিন কে ঘাটতি থাকতে পারে। ভিটামিন কে ঘাটতি এড়াতে ভিটামিন কে১ ও ভিটামিন কে২ সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। পাতাযুক্ত সবুজ শাকসবজি, ব্রোকলি, শিম, মিষ্টি কুমড়া ও ডালিমের রসে ভিটামিন কে১ পাবেন এবং মুরগির পা ও উরুর মাংস, হাঁসের কলিজা, গরুর কলিজা, মাখন ও পনির (তৃণভোজী গরুর দুধ থেকে প্রস্তুতকৃত) ও ডিমের কুসুমে ভিটামিন কে২ রয়েছে।

ভিটামিন কে হলো চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিন, তাই এটি চর্বিযুক্ত খাবারের সঙ্গে খেলে ভালোভাবে শোষিত হয়। ১৯ বছর ও তদোর্ধ্ব বয়সের নারীদের প্রতিদিন ৯০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন কে প্রয়োজন, যেখানে এ বয়সের পুরুষদের প্রয়োজন ১২০ মাইক্রোগ্রাম। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ (এনআইএইচ) অনুযায়ী, অধিকাংশ লোক প্রতিদিন পর্যাপ্ত ভিটামিন কে পেয়ে থাকেন, কিন্তু আপনি কি খাচ্ছেন তার ওপর ভিত্তি করে ভিটামিন কে এর ঘাটতি হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। এছাড়া কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা ভিটামিন কে শোষণ ব্যাহত করতে পারে। আপনার শরীরের জন্য ভিটামিন কে কেন প্রয়োজন তা ভিটামিন কে ঘাটতির লক্ষণগুলো সম্পর্কে জানা থাকলেই বুঝতে পারবেন।

ভিটামিন কে ঘাটতির লক্ষণ:

* আপনার রক্ত জমাট বাধছে না অথবা অত্যধিক রক্তক্ষরণ হচ্ছে

আপনার ক্ষতে রক্ত দ্রুত জমাট না বাধলে বিপজ্জনক মাত্রায় রক্ত হারাতে পারেন এবং ইনজুরি থেকে মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যাবে, ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার একটি রিপোর্ট অনুসারে। ‘সতর্ককারী লক্ষণের মধ্যে ভারী পিরিয়ড, নাক থেকে রক্তক্ষরণ, মূত্র বা মলে রক্ত ও মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ অন্তর্ভুক্ত।’ ভিটামিন কে এমন একটি এনজাইমের সঙ্গে কাজ করে যা প্রোথ্রম্বিনের সিন্থেসিসের জন্য প্রয়োজন- প্রোথ্রম্বিন হলো একটি প্রোটিন যা রক্ত জমাটবদ্ধতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, বলেন নিউ জার্সির রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ান শেরিল বাকলি।

* আপনার হাড় দুর্বল হয়ে যাচ্ছে

ভিটামিন কে হাড়ের স্বাস্থ্যে অবদান রাখে। কিছু গবেষণায় পাওয়া গেছে, বেশি পরিমাণে ভিটামিন কে গ্রহণে হাড়ের খনিজ ঘনত্ব বেড়ে যায় ও লোয়ার হিপ ফ্র্যাকচারের ঝুঁকি কমে যায়, এনআইএইচ অনুসারে। ডা. জুলসন বলেন, ‘সেই অবস্থাকে ভিটামিন কে ঘাটতি বলা হয়, যখন শরীর ফাংশনকে সর্বোচ্চ সাপোর্ট দেয়ার জন্য যথেষ্ট ভিটামিন কে পায় না, যেমন- হাড় ও হার্টের স্বাস্থ্য।’

* আপনার হার্টে সমস্যা অনুভূত হচ্ছে

ভিটামিন কে এর মাত্রা কমে গেলে হাড়ের পরিবর্তে নরম টিস্যুতে ক্যালসিয়াম জমা হতে পারে, যেমন- ধমনী। এটি কেবলমাত্র হাড়কেই দুর্বল করেনা, এটি (ভাসকুলার ক্যালসিফিকেশন বা রক্তনালিতে ক্যালসিয়াম জমে যাওয়া) করোনারি হৃদরোগের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ ফ্যাক্টর। ক্রনিক কিডনি রোগের লোকেরা ভাসকুলার ক্যালসিফিকেশনের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।

* আপনার আর্থ্রাইটিসের উপসর্গ রয়েছে

শরীরে ভিটামিন কে এর মাত্রা খুব কমে গেলে অথবা ভিটামিন কে ঘাটতি হলে আপনার হাড় ও কার্টিলেজ প্রয়োজনীয় খনিজ পাবে না। এটি অস্টিওআর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি উচ্চ করতে পারে, জার্নাল অব নিউট্রিশন অ্যান্ড মেটাবলিজমে প্রকাশিত রিভিউ গবেষণা অনুসারে। এ বিষয়ে গবেষণা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, তাই নিশ্চিত হতে আরো গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

ভিটামিন কে ঘাটতির কারণ:

ভিটামিন কে সমৃদ্ধ খাবার না খেলে ভিটামিন কে ঘাটতি হবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু কিছু লোক ভিটামিন কে সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া সত্ত্বেও এ ভিটামিনের ঘাটতিতে ভুগেন, কারণ তাদের শরীর এ ভিটামিনটি ভালোভাবে শোষণ করতে পারছে না। এখানে মানব শরীরে ভিটামিন কে শোষণ না হওয়ার কারণগুলো উল্লেখ করা হলো:

* আপনার সেলিয়াক রোগ অথবা অন্য কোনো পরিপাকতান্ত্রিক সমস্যা রয়েছে

যেসব লোকের গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল ডিসঅর্ডার বা পরিপাকতান্ত্রিক রোগ অথবা পুষ্টি শোষণ সংক্রান্ত সমস্যা রয়েছে তাদের শরীরে ভিটামিন কে ভালোভাবে শোষিত না হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। ভিটামিন কে শোষণে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে এমন কিছু পরিপাকতান্ত্রিক সমস্যা হলো- সিস্টিক ফাইব্রোসিস, আলসারেটিভ কোলাইটিস, ক্রনিক প্যানক্রিয়েটাইটিস, ইনফ্ল্যামেটরি বাওয়েল ডিজিজ, শর্ট বাওয়েল সিন্ড্রোম ও অন্ত্রে প্রতিবন্ধকতা। আপনার ব্যারিয়াট্রিক সার্জারি হলেও ভিটামিন কে ঘাটতির উচ্চ ঝুঁকিতে থাকবেন। যদি মনে করেন যে আপনি ভিটামিন কে ঘাটতির উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন, তাহলে ভিটামিন কে সাপ্লিমেন্ট সেবন করতে হবে কিনা জানতে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন।

* আপনি অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করছেন

আপনি কি অ্যান্টিবায়োটিকের ডোজ নিচ্ছেন? সেফালোস্পোরিন অ্যান্টিবায়োটিক অন্ত্রের সেসব ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করতে পারে যা ভিটামিন কে উৎপাদন করে। যদি আপনাকে কয়েক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে এসব অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করতে হয়, তাহলে ভিটামিন কে সাপ্লিমেন্ট সেবনের কথা বিবেচনা করতে পারেন।

* আপনি বাইল অ্যাসিড সিকোয়েস্ট্র্যান্ট গ্রহণ করছেন

কোলেস্টাইরামিন ও কোলেস্টিপলের মতো ওষুধ পিত্তের অ্যাসিড পুনরায় শোষণ প্রতিরোধ করে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করতে পারে। এ প্রক্রিয়ার সময় এসব ওষুধ ভিটামিন কে এর মতো চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিনের শোষণও হ্রাস করতে পারে। যদি আপনি বাইল অ্যাসিড সিকোয়েস্ট্র্যান্ট গ্রহণ করেন, তাহলে ভিটামিন কে ঘাটতি এড়াতে ভিটামিন কে সাপ্লিমেন্ট সেবনের প্রয়োজন হবে কিনা জানতে চিকিৎসকের সঙ্গে আলাপ করুন।

* নবজাতকের ভিটামিন কে ঘাটতি

দ্য আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব পিডিয়াট্রিকস প্রত্যেক নবজাতককে জন্মের সময় ০.৫ থেকে ১ মিলিগ্রাম ভিটামিন কে এর সিঙ্গেল ডোজ দিতে সুপারিশ করছে। এর কারণ হলো ভিটামিন কে গর্ভফুল অতিক্রম করে গর্ভস্থ বাচ্চার কাছে তেমন একটা পৌঁছতে পারে না এবং নবজাতকের প্রথম কয়েক সপ্তাহে ভিটামিন কে ঘাটতি ভিটামিন কে ডেফিশিয়েন্সি ব্লিডিং (ভিকেডিবি) নামক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এ দশায় পর্যাপ্ত ভিটামিন কে এর অভাবে রক্ত জমাট বাধতে পারে না বলে শিশুর রক্তক্ষরণ থামে না। নবজাতকেরা এই রক্তক্ষরণ দশার উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে, কারণ জন্মের সময় তাদের শরীরে সঞ্চিত ভিটামিন কে এর মাত্রা খুব কম থাকে, মায়ের দুধে ভিটামিন কে এর ঘনত্ব কম এবং নবজাতকের জিআই ট্র্যাক্টে এখনো ভিটামিন কে উৎপাদনকারী আন্ত্রিক ব্যাকটেরিয়ার বসতি গড়ে ওঠেনি। মাথার খুলিতে ভিকেডিবি হলে তা প্রাণনাশক হতে পারে।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button