অর্থনীতি

বছরে ৩১৫ কোটি ডলার পাচার করছেন বিদেশীরা টিআইবির দাবি

দেশে বৈধ-অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশীর সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। এদের হাত দিয়ে প্রতি বছর বিদেশে অবৈধ পন্থায় চলে যাচ্ছে বা পাচার হচ্ছে কমপক্ষে ৩১৫ কোটি ডলার, অর্থাৎ ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ফলে প্রতি বছর সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে ১৩৫ কোটি ডলার বা ১২ হাজার কোটি টাকা।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণার পর্যবেক্ষণে এ তথ্য উঠে এসেছে। রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ তথ্য জানান।

‘বাংলাদেশে বিদেশীদের কর্মসংস্থান: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এর ওপর ভিত্তি করে নয় দফা সুপারিশও উপস্থাপন করেছে টিআইবি।

গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন টিআইবির প্রোগ্রাম ম্যানেজার (রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি) মনজুর-ই-খোদা। তিনি জানান, দেশের বিভিন্ন খাতে কর্মরত রয়েছেন ৪৪টির বেশি দেশ থেকে আসা বিদেশীরা। এসব বিদেশীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভারতীয় নাগরিক।

সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও গণমাধ্যমকর্মীদের সাক্ষাত্কার এবং আইনি নথি-নীতিমালা, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্য, গবেষণা প্রতিবেদন ও গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে এ গবেষণা হয়েছে। এজন্য কোনো জরিপ চালানো হয়নি, শুধু তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

সংস্থাটি জানায়, বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে কর্মরত বিদেশী কর্মীদের প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে খাতসংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, দেশে সবচেয়ে বেশি বিদেশী কর্মী কর্মরত তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল সংশ্লিষ্ট খাতগুলোয়। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, আন্তর্জাতিক এনজিও, চামড়া শিল্প, চিকিৎসাসেবা এবং হোটেল ও রেস্তোরাঁয়ও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদেশী কর্মরত।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত অর্থবছরে (২০১৮-১৯) কর অঞ্চল ১১-এর অধীনে আয়কর দিয়েছেন মোট সাড়ে ৯ হাজার বিদেশী কর্মী। এদের সম্মিলিত আয়করের পরিমাণ ছিল ১৮১ কোটি টাকা। মোট আয়ের ৩০ শতাংশ আয়কর হিসেবে এ সময় বিদেশী কর্মীদের মোট আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০৩ কোটি টাকা। মাসিক গড় বেতন দাঁড়ায় প্রায় ৫৩ হাজার টাকা বা ৬০০ ডলারের কাছাকাছি।

কিন্তু গবেষণায় পাওয়া তথ্য বলছে, বিদেশী কর্মীদের মাসিক গড় আয় কমপক্ষে দেড় হাজার ডলার। প্রদত্ত আয়করের পরিমাণ থেকে পাওয়া হিসাব অনুযায়ী বিদেশী কর্মীদের গড় মাসিক বেতনের পরিমাণ থেকে প্রমাণ হয়, কর ফাঁকির উদ্দেশ্যে বৈধ প্রক্রিয়ায় কর্মরত বিদেশী কর্মীদের প্রকৃত বেতন গোপন করা হয় এবং অপেক্ষাকৃত কম বেতন প্রদর্শন করা হয়।

এ প্রসঙ্গে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যারা রিটার্ন দিচ্ছেন, তারাও মূল আয় গোপন করে অল্প রিটার্নের ঘোষণা করছেন। এতে নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান ও নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তি উভয়ই লাভবান হচ্ছেন। তবে এতে রাষ্ট্র বড় ধরনের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশে বৈধ ও অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশী কর্মীর সংখ্যা, দেশ থেকে অবৈধভাবে পাঠানো রেমিট্যান্স ও রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ উদ্বেগজনক। বাংলাদেশে বিদেশী কর্মী নিয়োগে কোনো সমন্বিত ও কার্যকর কৌশলগত নীতিমালা নেই।

তিনি বলেন, দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে। রাজস্ব আয় যা হওয়ার কথা, সেটা আমরা ব্যাপকভাবে হারাচ্ছি। এতে যারা অনিয়ম করে কাজ করছেন বা কাজ দিচ্ছেন তাদের যেমন দায় আছে, একইভাবে যাদের মাধ্যমে একই ব্যক্তিকে অল্প সময়ের মধ্যে পর্যটন ভিসা দেয়া হয়, তাদেরও দায় রয়েছে।

এ সময় ড. ইফতেখারুজ্জামান আরো বলেন, শিল্প ও সেবা খাতের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা বেড়েছে, যেটা আমাদের উন্নয়নের লক্ষণ। সময়ের সঙ্গে আমাদের বিনিয়োগও বেড়েছে। তবে তা আরো বেশি হতে পারত। তবে যেটুকু হয়েছে, তা লক্ষ করার মতো। শিল্পের প্রয়োজনেই আমাদের এখানে বিদেশী জনবলের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। কিন্তু নানা অনিয়মের কারণে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে।

টিআইবির গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশীরা এখানে ভিসা নিয়ে অবস্থান করলেও এদের সবাই অনুমতি নিয়ে কাজ করেন না। যারা অনুমতি ছাড়াই কাজ করছেন, তারা সাধারণত পর্যটক ভিসা নিয়ে অবস্থান করেন, যার মেয়াদ সর্বোচ্চ তিন মাস। এক্ষেত্রে প্রতি তিন মাস পর পর তারা নিজ দেশে ফিরে যান। এরপর দ্রুত নতুন পর্যটন ভিসা নিয়ে এসে একই বা একই ধরনের কাজে যোগদান করেন তারা। বাংলাদেশে পর্যটন ভিসায় আগতদের ৫০-৭০ শতাংশ আসেন কাজের উদ্দেশ্যে। এমনকি সরকারি প্রকল্পে যেসব বিদেশী কাজ করছেন, তাদেরও অনেকে ভ্রমণ ভিসায় এসে কাজ করছেন বলে জানা গেছে।

গবেষণায় দেশে বিদেশী কর্মী নিয়োগে অবৈধ অর্থের লেনদেনের বিষয়ও তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, ভিসার সুপারিশপত্র, বিদেশে বাংলাদেশ মিশন থেকে ভিসা সংগ্রহ, বিদেশী নাগরিক নিবন্ধন, কাজের অনুমতি, এসবি-এনএসআই ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা ছাড়পত্র এবং ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধিতে মাথাপিছু ২৩ থেকে ৩৪ হাজার টাকার নিয়মবহির্ভূত অর্থ লেনদেন হয়।

এছাড়া বিদেশী কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দেশী বিশেষজ্ঞ না খোঁজা, কর ফাঁকি, একই প্রতিষ্ঠানে পাঁচ বছরের বেশি কাজ করানো, ভিসা নীতি লঙ্ঘন ও বিদেশী কর্মীর বেতন কম দেখানোর অভিযোগও করেছে টিআইবি।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার (রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি) শাহজাদা এম আকরাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Back to top button