স্বাস্থ্য

শিশু-কিশোরদের ভিটামিন ডি ঘাটতি

সমসায়িককালে ভিটামিন ডি ব্যাপক আলোচনার কেন্দ্রে অবস্থান করছে। তবে তা প্রধানত প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষদের ক্ষেত্রে, যাদের ডায়াবেটিস আছে, হৃদরোগ-স্ট্রোক হয়েছে, প্রজনন সমস্যা আছে, পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম আছে ও দৈহিক স্থূলতায় আক্রান্ত, এদেরকে নিয়েই আলোচনা আবর্তিত হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে গর্ভকালীন সময়ে ভিটামিন ডি এর মাত্রা নিয়েও যথেষ্ট গবেষণা হচ্ছে। তবে শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে ভিটামিন ডি এর পরিমাণ ও অভাবজনিত সমস্যা আলোচনাটি এখনও ব্যাপক মাত্রা পাইনি, যদিও বিষয়টি ব্যাপক গুরুত্বের দাবিদার।

বাড়ন্তকালে শিশুদের দৈহিক কাঠামো তৈরি করার অন্যতম কাঁচামাল ক্যালসিয়াম- যা শরীরের ভিটামিন ডি দ্বারা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত হয়। শিশুদের দৈহিক বৃদ্ধি, দৈহিক স্থূলতা সবকিছু ভিটামিন ডি-র সাথে নিবিড়ভাবে সংশ্লিষ্ট। বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই কম বয়সি শিশু-কিশোরদের টাইপ ২ ডায়াবেটিস ক্রমশ: বেশি মাত্রায় দেখা দেওয়ার পিছনে ভিটামিন ডি-র ঘাটতি একটি বড় কারণ হয়ে থাকতে পারে। ভিটামিন ডি-র ঘাটতিতে কিছু কিছু ক্যান্সার হবার ঝুঁকিও বেড়ে যেতে পারে।

নাম শুনে ভিটামিন মনে হলেও ভিটামিন ডি আসলে একটি স্টেরোয়েড হরমোন। অন্যান্য ভিটামিন যেখানে এন্টি অক্সিজেন বা কো-এনজাইম হিসাবে কাজ করে, ভিটামিন ডি (স্টেরোয়েড হরমোন) জিন এক্সপ্রেশন নিয়ন্ত্রণ করে অর্থাৎ দেহের প্রোটিন তৈরিতে নিয়ন্ত্রণকারীর ভ‚মিকায় থাকে। প্রাণীজ ও উদ্ভিদজাত স্টেরল ও ফাইটোস্টেরল হতে সূর্যালোকের অতি বেগুনী রশ্মি দ্বারা রূপান্তরিত হয়ে দেহে ভিটামিন ডি তৈরি হয়। ভিটামিন ডি-২ ও ভিটামিন ডি-৩ মানব দেহে থাকে।

ভিটামিন ডি-র পরিমাপ:
রক্তের সিরামে ভিটামিন ডি-র মাত্রা পরিমাপ করা হয়। একজন হরমোন বিশেষজ্ঞ বা অন্য কোন চিকিৎসক যখন রোগীটির, রোগীনিটির দেহে ভিটামিন ডি-র ঘাটতি সন্দেহ করলে তার রক্তের ভিটামিন ডি [২৫(ঙঐ)উ] পরিমাপ করার উদ্যোগ নিবেন। তবে ভিটামিন ডি ঘাটতি ও পরবর্তী চিকিৎসা পদ্ধতি নিরুপনের জন্য রক্তের ক্যালসিয়াম, প্যারাথায়রয়েড হরমোন ও ফসফরাসের মাত্রাও দেখে নিতে হয়। রোগীর দেহে প্রাপ্ত ভিটামিন ডি-র

মাত্রা অনুসারে তাকে যেকোন দলভুক্ত করা হয়ঃ
রক্তে মাত্রাতিরিক্ত ভিটামিন ডি থাকলে একই সাথে রক্তে ক্যালসিয়াম, প্র¯্রাবে ক্যালসিয়াম এবং রক্তে ফসফেটের মাত্রা বেশি থাকতে পারে। সূর্যরশ্মি ভিটামিন ডি তৈরি করতে যেমন সহায়ক, তেমনই অতিরিক্ত ভিটামিন ডি ধ্বংশ করতে ভ‚মিকা রাখে। তাই শুধুমাত্র সূর্যরশ্মি থেকে মাত্রাতিরিক্ত ভিটামিন ডি শরীরে জমানোর সম্ভাবনা নাই বল্লেই চলে। অর্থাৎ শরীরে অতিরিক্ত ভিটামিন ডি জমার কারণ প্রধানত: অতিরিক্ত পরিমান ভিটামিন ডি খাওয়া। শিশুদের ক্ষেত্রে ভিটামিন ডি ইনজেকশন, ক্যাপসুল অথবা বিভিন্ন রকম খাদ্যে ভিটামিন ডি যুক্ত করে (ভিটামিন ডি ফর্টিফায়েড) খাবার খেয়ে অতিরিক্ত ভিটামিন ডি দেহে জমা হবার সম্ভাবনা থাকে।
এদের ক্ষেত্রে শরীরে ভিটামিন ডি-র পরিমাণ বেড়ে গেলে যে লক্ষণগুলো দেখা দিবে- তা প্রধানত রক্তে ক্যালসিয়াম বেড়ে যাওয়ার লক্ষণসমূহঃ শারীরিক দূর্বলতা, কোষ্ঠকাঠিণ্য, খুধামন্দা, বমি ভাব অথবা বমি হওয়া ইত্যাদি। এ সময় রক্তের ক্যালসিয়াম মাপলে ১৩.৪-১৮.৮ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার এর মধ্যে থাকতে পারে। ভিটামিন ডি [২৫(ঙঐ)উ] ৩৪০-৯৬২ নেনোগ্রাম হতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে কাঙ্খিত মাত্রার চেয়ে ৪ হাজার গুণ বেশি হতে পারে। এক্ষেত্রে ভিটামিন ডি যুক্ত মুখে খাবার ওষুধ, ভিটামিন ডি-র ফর্টিফায়েড খাদ্য সমূহ খাওয়া বন্ধ রেখে প্রচুর পানি পান করলে তিন দিনের মধ্যেই অতিরিক্ত ভিটামিন ডি-র প্রভাব জনিত লক্ষণসমূহ দূর হবে এবং ক্রমশ: শরীরে এর মাত্রা স্বাভাবিক হয়ে আসতে থাকবে। তবে পরবর্তীতে এ ঘটনার যেন পুন:রাবৃত্তি না ঘটে সেদিকে নজর রাখতে হবে।
ভিটামিন ডি-র ঘাটতিতে খুব দ্রূত কোন শারীরিক লক্ষণ দেখা দিবে না। বিভিন্ন রকম অসম্পৃক্ত (আপাত:দৃষ্টিতে) শারীরিক সমস্যা নিয়ে শিশু-কিশোরদেরকে চিকিৎসকদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সাধারণত শরীরের বিভিন্ন অংশের ব্যাথা (মাংশ, হাড় ও অস্থিসন্ধিতে) দ্রæত দৈহিক ওজন বৃদ্ধি পাওয়া, কাঙ্খিত দৈহিক উচ্চতা অর্জন করতে ব্যর্থ হওয়া। বালিকাদের ক্ষেত্রে মাসিক অনিয়মিত হওয়া বা সঠিক সময়ে মাসিক শুরু না হওয়া। বালকদের ক্ষেত্রে বয়:সন্ধিকাল শুরু হতে দেরি হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ বা উপ:স্বর্গ থাকতে পারে। অর্থাৎ ভিটামিন ডি-র ঘাটতি শনাক্ত করার ক্ষেত্রে যে কোন লক্ষণকে গুরুত্ব দিয়ে রক্তে ভিটামিন ডি-র মাত্রা নিরুপনের উদ্যোগ নিতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যে ভিটামিন ডি-র ঘাটতির মাত্রা বিভিন্ন রকম। কিন্তু সব দেশেই বিপুল সংখ্যক মানুষ ভিটামিন ডি-র ঘাটতিতে ভুগছে। যুক্তরাষ্ট্রের ১০ শতাংশের বেশি (শিশু ৬-১৮ বছর বয়সি) ভিটামিন ডি-র মারাত্ম ঘাটতিতে আক্রান্ত। এক্সরেতে এসব শিশুর হাড়ের ঘনত্ব কম দেখা গিয়েছে। আমাদের দেশের শিশু-কিশোরদের মধ্যে ভিটামিন ডি-র ঘাটতি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি মাত্রায় হবে ধারণা করা গেলেও বর্তমান সময়ে এর কোন সঠিক পরিসংখ্যান জানা নেই।

ভিটামিন ডি-র উৎস :

৪০ ওট ভিটামিন ডি-র কার্যকারিতা ১ মাইক্রোগ্রাম সমতুল্য।
সূর্যালোক থেকে ভিটামিন ডি পেতে হলে মার্চ-অক্টোবর মাসের (অন্যান্য মাসগুলোতে আরো বেশি সময় ধরে) প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট রোদ পোহাতে হবে যখন শরীরের ১৮ শতাংশের বেশি অংশে রোদ লাগবে।
১-৭০ বছর বয়সি মানুষের গড়ে প্রতিদিন ৬০০ ওট এবং ৭০ বছরের বেশি বয়সিদের ৮০০ ওট ভিটামিন ডি গ্রহণ করা দরকার।
ভিটামিন ডি ওষুধ হিসাবে খেতে হবে কাদের :
১। নবজাতক যারা শুধুই মায়ের দুগ্ধ পান করছে ও যারা ১০০০ মিলিলিটারের কম শিশু খাদ্য গ্রহণ করে।
২। শিশু-কিশোর যারা অপরিকল্পিত ভাবে গড়ে উঠা নগরে বা অস্বাস্থ্যকর শহরে (ঢাকা অন্যতম) বসবাস করছে।
৩। দৈহিক স্থ’ল শিশু-কিশোর যাদের ত্বকের বিভিন্ন অংশে মকমলের মতো কালো অংশ দেখা দিচ্ছে।
৪। ধর্মীয় বা অন্য কারণে পোশাকে প্রায় সারাদেহ আবৃত শিশু-কিশোর।
৫। খাদ্য নালীর সমস্যার কারণে হজম ও বিপাকীয় কার্যক্রম হ্রাস পেলে।
৬। প্রাতিষ্ঠানিক জীবন যাপন (হেস্টেল, হাসপাতাল বা অফিস) যাতে রোদে যাবার সুযোগ কমে যায়।

ভিটামিন ডি-র ঘাটতি খুব বেশি হলে ৪০ হাজার ওট সপ্তাহে এবং পরবর্তীতে মাসে একটি করে ভিটামিন ডি ক্যাপসুল খেয়ে যেতে হবে। ঘাটতি কম হলে ২০ হাজার ওট ক্যাপসুল যথেষ্ট হতে পারে। ভিটামিন ডি-র ঘাটতি থাকলে তো বটেই, অন্য ক্ষেত্রেও, সকলকে সূর্যালোকে যেতে হবে নিয়মিত। দূর্ভাগ্যবশত: বাংলাদেশে প্রচলিত খাদ্যসমূহে ভিটামিন ডি-র উপস্থিতি খুবই কম, তারপরও যেসব খাদ্যে ভিটামিন ডি-র কিছু পরিমাণে উপস্থিতি আছে  তা যতটা সম্ভব নিয়মিত খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। সুস্থ্য সবল শিশু-কিশোর আগামী দিনের মেধাবি ও কর্মঠ জাতি গঠন করবে।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button