স্বাস্থ্য

কিশোর-কিশোরীদের বাড়ছে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি

কৈশোরের সময়টা দুরন্তপনার। খেলাধুলা ও হই-হুল্লোড়ে কেটে যায় এই বয়স। ফলে এই বয়সের মানুষের প্রতিরোধক্ষমতাও বেশি। অথচ বাংলাদেশে এই বয়সী শিশু-কিশোরদের অনেকেরই শরীরে নীরবে বাসা বাঁধছে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি।

চাঁদপুরের ব্যবসায়ী দম্পতির দুই মেয়ে সুহানা ও সাহানা (ছদ্মনাম)। দুই বোনের মধ্যে সুহানার ডায়াবেটিস ধরা পড়ে ১৩ বছর বয়সে। আর ছোট সাহানার যখন রোগটি ধরা পড়ে তখন তার বয়স ৮।

বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলছেন, মানবদেহে তিন থেকে ছয় মাস বা অনেক ক্ষেত্রে তার বেশি সময় লুকিয়ে থাকতে পারে প্রি-য়াবেটিস, যা পরবর্তী সময়ে একজন সুস্থ মানুষকে সারা জীবনের জন্য ডায়াবেটিসের রোগীতে পরিণত করে। বর্তমানে গ্রাম-শহর সবখানেই বড়দের পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের মধ্যেও এই প্রি-ডায়াবেটিসের প্রবণতা বেড়েছে।

ডায়াবেটিস শনাক্তে প্রচলিত কয়েকটি পদ্ধতির একটি হলো ‘এইচবিএ১সি’ পরীক্ষা।এই পরীক্ষা অনুযায়ী, রক্তে সুগারের মাত্রা ৬ দশমিক ৫ শতাংশ বা তার ওপরে চলে গেলে সেই অবস্থাকে ডায়াবেটিস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আর রক্তে সুগারের মাত্রা ৫ দশমিক ৭ থেকে ৬ দশমিক ৪ শতাংশের মধ্যে থাকলে সে অবস্থাকে প্রি-ডায়াবেটিস বলে বিবেচনা করা হয়।

উঠতি বয়সীদের ডায়াবেটিস প্রতিরোধের লক্ষ্যে একটি গবেষণা চালাচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিমের তত্ত্বাবধানে গবেষকদের একটি দল। ‘ডায়াবেটিস প্রিভেনশন ইন ইয়াং’ শীর্ষক এ গবেষণার আওতায় এরই মধ্যে ঢাকা ও টাঙ্গাইলে ১৬ থেকে ২১ বছর বয়সী কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ডায়াবেটিস পরীক্ষা করেছেন তারা। ঢাকার ৩৫০ জন শিক্ষার্থীর রক্ত পরীক্ষায় দেখা যায়, তাদের ১৮ জনের রক্তে সুগারের মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশের ওপরে। অর্থাত্ এই ১৮ জন কৈশোরের গণ্ডি না পেরোতেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছে এবং অগোচরে শরীরে এই রোগটি বহন করছিল। এছাড়া শিক্ষার্থীদের বাকি অংশের মধ্যে ১৭৫ জনের রক্তে ৫ দশমিক ৬ থেকে ৬ দশমিক ৪ মাত্রার সুগার পাওয়া গেছে। একই বয়সী কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের আরেকটি অংশের ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা হয়েছে টাঙ্গাইল জেলায়। সেখানে ৬৩ জনের রক্ত পরীক্ষায় ১১ জনের ডায়াবেটিস ও ৩১ জনের প্রি-ডায়াবেটিস চিহ্নিত হয়েছে।

মোটা দাগে খাদ্যাভ্যাসে ভারসাম্যহীনতা ও শরীরচর্চার অভাবকে প্রি-য়াবেটিসের জন্য দায়ী করা হলেও জীবনযাপনে অনিয়ম, পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ এবং অস্বাস্থ্যকর নগরায়ণকেও প্রভাবক হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। চিকিত্সকদের মতে, প্রি-ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে একটা সময় নিরাময় করা সম্ভব। যদিও অধিকাংশ মানুষই এ সম্পর্কে সচেতন নয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশে ডায়াবেটিসের যত রোগী আছে, তাদের মধ্যে ৫০ শতাংশের মতো রোগীকে শনাক্ত করা হয়েছে। বাকিদের যে ডায়াবেটিস আছে, সেটা বুঝে উঠতে পারে না। যেটা পরবর্তী সময়ে বড় কোনো রোগে পরিণত হচ্ছে। আরো শঙ্কার বিষয় হচ্ছে দেশে শনাক্ত হওয়া রোগীদের ৬৪ শতাংশের মধ্যেই প্রি-ডায়াবেটিস ছিল। প্রায় ৮০ ভাগ প্রি-ডায়াবেটিসের রোগীকে কিন্তু সুস্থ করে তোলা সম্ভব। কিন্তু বিষয়টি না ধরতে পারায় তা ডায়াবেটিসে রূপান্তর হয়ে আজীবনের জন্য ভোগান্তির কারণ হয় বলে জানান তিনি।

প্রি-য়াবেটিসের কোনো লক্ষণ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এর বিশেষ কোনো লক্ষণ দেখা যাবে না। বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে নিয়মিত চেকআপ করতে হবে। যেহেতু এটা আমাদের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের একটা ফল, সেহেতু সবারই ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা উচিত বলে আমি মনে করি। পাঠ্যবইয়ে পাবলিক হেলথ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে সে অনুযায়ী জীবনযাপনের পরামর্শ দেন এ বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক।

শিশু-শোর ডায়াবেটিস রোগীদের সেবা প্রদানের জন্য রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে ২০১০ সাল থেকে পরিচালিত হচ্ছে ‘চেঞ্জিং ডায়াবেটিস ইন চিলড্রেন’ শীর্ষক প্রকল্প। এ প্রকল্পের আওতায় ২০১৯ সালে ৬ হাজার ৩৪৭ জন রোগীকে সেবা প্রদান করা হয়, যাদের বয়স ২০ বছরের মধ্যে। প্রকল্পের মাধ্যমে টাইপ-১ ও টাইপ-২ দুই ধরনের রোগীকেই সেবা প্রদান করা হয়। এদের বড় একটি অংশ শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সী টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগী, যারা নিয়মিত ইনসুলিন গ্রহণ করে থাকে।

ডায়াবেটিস শরীরে আছে বিষয়টি না জানা এবং উঠতি বয়সীদের মধ্যে প্রি-য়াবেটিসের এই প্রবণতা ভবিষ্যতে শঙ্কা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করছেন বাংলাদেশে এন্ডোক্রাইন সোসাইটির সভাপতি ও বারডেমের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. ফারুক পাঠান। তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিংবা আশপাশে খেলার মাঠ নেই। নগরে ইমারত উঠছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বসবাস করার জায়গা কমছে। ফলে শিশুরা শরীরচর্চার সুযোগটিও পাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে এখনই সচেতনতা না বাড়ানো গেলে ডায়াবেটিস জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের সংকট হিসেবে দেখা দিতে পারে।

বর্তমানে বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির নিবন্ধনকৃত রোগীর সংখ্যা ৪৯ লাখ ৭১ হাজার ৫৮১ জন।  সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা ডায়াবেটিস সমিতির শাখা, উপশাখা থেকে এ তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তবে বিশ্ব ডায়াবেটিস ফেডারেশনের দেয়া আরেক তথ্য বলছে, দেশে রোগীর সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ।

লুকিয়ে থাকা প্রি-য়াবেটিস পরবর্তী ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ও জনস্বাস্থ্যে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির মহাসচিব মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, জীবনযাপনে অসাবধানতা, ফাস্টফুড খাওয়া ও বাড়তি ওজন উঠতি বয়সীদের ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে ফেলছে। সর্বশেষ বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসে আমরা দেশের প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার মানুষের ডায়াবেটিস পরীক্ষা করি। পরে ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তাদের ২৬ শতাংশই ডায়াবেটিসের রোগী। শরীরে প্রি-ডায়াবেটিস যে লুকিয়ে ছিল, পরীক্ষা না করার ফলে সেটাই তারা জানত না। এটা ভালো কোনো সংবাদ নয়। প্রি-ডায়াবেটিস নির্ণয় করা গেলে, তা ৭০-৮০ শতাংশ প্রতিরোধ করা সম্ভব। এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Back to top button