স্বাস্থ্য

গ্যাস্ট্রোপ্যারেসিস কী ?লক্ষণ ও প্রতিকার

‘গ্যাস্ট্রো’ কথার অর্থ পাকস্থলী এবং ‘প্যারেসিস’ মানে কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া। অর্থাৎ পাকস্থলীর খাবার হজম করার শক্তি কমে যাওয়াকেই ডাক্তারি পরিভাষায় বলা হয় ‘গ্যাস্ট্রোপ্যারেসিস’। সাধারণত একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের পাকস্থলী থেকে ৯০-৯৫% খাবার হজম হতে মোটামুটি ৪-৫ ঘণ্টা সময় লাগে। কিন্তু বিশেষ কিছু শারীরিক অবস্থায় এই সময়সীমা বেড়ে যেতে পারে। ফলে অল্প খাবার খেলেই পেট ভর্তির অনুভূতি হওয়া বা খাওয়ার পর পেট অনেকক্ষণ ফেঁপে থাকা, সারাদিন ব্লোটেড ফিল করার মতো অনুভূতি হয়। অনেকসময় মনে হতে পারে খাবার গলা দিয়ে হয়তো নামছেই না। গ্যাস্ট্রোপ্যারেসিসে এই ধরনের অনুভব হওয়া খুব স্বাভাবিক। একই কারণে এই সমস্যায় খাওয়াদাওয়ার পরিমাণও বেশ কমে যায়। ফলস্বরূপ দুর্বলতা তথা অন্যান্য শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়।

কেন হয় গ্যাস্ট্রোপ্যারেসিস?

গ্যাস্ট্রোপ্যারেসিস হওয়ার পিছনে বিভিন্ন শারীরিক অবস্থা থাকতে পারে। যাঁরা দীর্ঘদিন ডায়াবিটিস অথবা থাইরয়েডে ভুগছেন বা আনকন্ট্রোলড ডায়াবিটিস কিংবা থাইরয়েডিজম রয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে মূলত এই সমস্যা দেখা দেয়। ডায়াবিটিসের বিভিন্ন ওষুধ যেমন মেটাফরমিন, জিএলপি অ্যানালগ ইত্যাদির কারণেও গ্যাস্ট্রোপ্যারেসিস হতে পারে। যাঁরা কোনও কারণে নারকোটিক পেনকিলার যেমন ট্রামাডল, পেথিডিন বা মরফিন নিতে অভ্যস্ত, তাঁদের ক্ষেত্রেও এই ধরনের ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াস্বরূপ গ্যাস্ট্রোপ্যারেসিস দেখা দিতে পারে। সাধারণত নির্দিষ্ট বয়সের পর পাকস্থলীর কার্যক্ষমতা এমনিতেই কমে আসে।

ফলে খাবার হজম হতে অনেক বেশি সময় লাগে। তাই ৭০ বা তার বেশি বয়সের মানুষদের ক্ষেত্রেও এই সমস্যা হতে পারে। এছাড়া পারকিনসনস, অ্যালজাইমার্স ইত্যাদি অসুখের ক্ষেত্রেও গ্যাস্ট্রোপ্যারেসিস খুব কমন। একধরনের চর্ম তথা মাল্টিঅর্গ্যান ডিসঅর্ডার স্ক্লেরোডার্মা থেকেও হতে পারে গ্যাস্ট্রোপ্যারেসিস। আমাদের শরীরে অ্যামাইলয়েড নামক একধরনের প্রোটিন রয়েছে। যদি তা কোনও কারণে শরীরে জমতে শুরু করে, সেক্ষেত্রে বিভিন্ন অঙ্গের ক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে। একে অ্যামাইলয়েডোসিস বলা হয়। যদি এই সমস্যা পাকস্থলীতে দেখা যায়, সেক্ষেত্রেও গ্যাস্ট্রোপ্যারেসিস হতে পারে।

লক্ষণ:

অল্প খেলেই পেট ভরে যাওয়া বা আর্লি স্যাটাইটি, খাওয়াদাওয়ার পর অনেকক্ষণ পেট ভর্তি থাকা বা পোস্ট প্র্যানডিয়াল ফুলনেস এই দু’টি গ্যাস্ট্রোপ্যারেসিসের সবথেকে কমন লক্ষণ। এছাড়া আপার অ্যাবডমেনে ব্যথা, ব্লোটিং, নসিয়া, কিছু খেলেই বমি হয়ে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণও দেখা দিতে পারে।

ডায়াগনসিস:

গ্যাস্ট্রোপ্যারেসিসের ডায়গনোসিসের জন্য পেশেন্টের মেডিকেল হিস্ট্রি এবং শারীরিক অবস্থা খুব গুরুত্বপূর্ণ দু’টি ফ্যাক্টর। সাধারণত এই ধরনের লক্ষণ নিয়ে কেউ এলে প্রথমেই ইউএসজি এবং পেটের এমআরআই করা হয়। সকালে খালি পেটে ইউএসজি করলে যদি পেটে খাবারের উপস্থিতি পাওয়া যায়, তবে বুঝতে হবে হজমে সমস্যা রয়েছে। এছাড়াও কিছু ইমেজিং টেকনিক রয়েছে। যেমন গ্যাস্ট্রিক সিন্টিগ্রাফি। এই পরীক্ষার মাধ্যমে গ্যাস্ট্রোপ্যারেসিসের প্রাবল্য বোঝা যায়। কতটা পরিমাণ খাবার পাকস্থলীতে অবশিষ্ট রয়েছে তার ভিত্তিতে মাইল্ড, মডারেট এবং সিভিয়ার গ্যাস্ট্রোপ্যারেসিস চিহ্নিত করা হয়। এছাড়া ইলেক্টোগ্যাস্ট্রোগ্রাফির মাধ্যমে স্টমাকের মোটিলিটি পরীক্ষা করে দেখা হয়। অ্যান্ট্রোডিওডেনাল ম্যানুমেট্রিও এখন বেশ কমন।

চিকিৎসা:

সাধারণত গ্যাস্ট্রোপ্যারেসিসের জন্য প্রোকাইনেটিক ড্রাগস যেমন মেটোক্লোপ্রোমাইড, ডোমপেডিডোম, লেভোসালফিরাইড, অ্যাকোশিয়ামাইড ইত্যাদি প্রেসক্রাইব করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এরিথ্রোমাইসিনও দেওয়া হয়। এই ওষুধ কার্যকরী না হলে সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে। যদি অ্যান্টিডিওডিনাল ম্যানুমেট্রি করে পাকস্থলীতে কোনও সমস্যা পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে অ্যানট্রামে বোটক্স ইনজেকশন দেওয়া হয়। এতে ওই অংশ বেশ খানিকটা রিল্যাক্স হয়ে যায় বলে খাবার হজম হতে সাহায্য করে। এছা়ড়া পাইলোরোপ্লাস্টি সার্জারির মাধ্যমে পাইলোরিক রিংকে ডায়ালেট করা হয়। ফলে খাবার হজমে সাহায্য হয়।

প্রতিকার:

যে কারণে গ্যাস্ট্রোপ্যারেসিস হচ্ছে প্রথমেই সেই কারণটা নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। ডায়াবিটিস বা থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। যদি কোনও ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াস্বরূপ এই অসুখ হয়, সেক্ষেত্রে সেই ওষুধ পরিবর্তন করা আবশ্যিক। এছাড়া ডায়েটারি ম্যানেজমেন্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ। অসুস্থ ব্যক্তির অল্প অল্প করে বার বার খাওয়া অভ্যেস করতে হবে। লোফ্যাট ডায়েট এই সমস্যার ক্ষেত্রে আদর্শ। কারণ ফ্যাট জাতীয় খাবার হজম হতে সবথেকে বেশি সময় লাগে। যাঁদের সিভিয়ার গ্যাস্ট্রোপ্যারেসিস রয়েছে, তাঁদের হোমোজিনাইজ়ড খাবার খেতে হবে। এতেও সমস্যআ না কমলে তাঁদের কৃত্রিম নল দ্বারা খাওয়ানো হয়। এক্ষেত্রে খাবার সরাসরি জেজুনামে পৌঁছয় বলে পাকস্থলীতে কোনও চাপ পড়ে না। অ্যাডভান্সড পারকিনসন বা অ্যালজ়াইমার্সের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। অ্যালকোহল অথবা স্মোকিংয়ের আসক্তি থাকলে তাও অবিলম্বে বন্ধ করা একান্ত প্রয়োজন।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button