স্বাস্থ্য

বাচ্চাদের জন্ডিস: লক্ষণ ও চিকিৎসা

বাচ্চাদের মধ্যে মূলত হেপাটাইটিস থেকেই জন্ডিস হয়ে থাকে। এর মধ্যে প্রধানত থাকে হেপাটাইটিস এ, বি এবং সি। অপরিষ্কার জল বা খাবার থেকে হেপাটাইটিস এ-র সংক্রমণ ঘটতে পারে।

জন্ডিস আমাদের সকলের কাছেই খুব পরিচিত শব্দ। আমরা সবাই জন্ডিস সম্পর্কে কমবেশি জানি। কিন্তু জানেন কী, জন্ডিস আসলে নিজে কোনও রোগই নয়, রোগের উপসর্গমাত্র। জন্ডিস হওয়ার অনেক রকম কারণ থাকতে পারে। তবে বাচ্চাদের মধ্যে হেপাটাইটিস থেকেই সবচেয়ে বেশি জন্ডিস হয়। হেপাটাইটিস হল লিভারের এক ধরনের প্রদাহ। আমাদের রক্তের লোহিত কণিকাগুলি একটা সময়ে স্বাভাবিক নিয়মেই ভেঙে গিয়ে বিলিরুবিন তৈরি করে। এই বিলিরুবিন পরবর্তীকালে লিভারে প্রক্রিয়াজাত হয়ে বাইল ডাক্টের মাধ্যমে পরিপাকতন্ত্রে প্রবেশ করে। এরপর অন্ত্র থেকে স্টুলের মাধ্যমে বিলিরুবিন শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। বিলিরুবিনের এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় কোনও অসঙ্গতি দেখা দিলে রক্তে বিলিরুবিন বেড়ে যায় আর দেখা দেয় জন্ডিস। জন্ডিসের কারণে ত্বক, মিউকাস মেমব্রেন ও চোখের সাদা অংশ হলুদ হয়ে যায়।

কারণ অনুযায়ী জন্ডিসকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা যায় — প্রি-হেপাটিক, হেপাটিক এবং পোস্ট-হেপাটিক। অ্যানিমিয়া, ম্যালেরিয়া বা থ্যালাসেমিয়ার মতো রোগে লোহিত রক্তকণিকাগুলি স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে না। এর ফলে জন্ডিস হতে পারে। একে বলে প্রি-হেপাটিক জন্ডিস। যদি হেপাটাইটিস, উইলস ডিজ়িজ় বা লেপ্টোস্পাইরোসিসের মতো লিভারের সমস্যার কারণে বিলিরুবিন বেড়ে যায়, তাকে বলে হেপাটাইটিক জন্ডিস। লিভার থেকে বিলিরুবিন বেরনোর পথে যদি কোনও সমস্যার সৃষ্টি হয়, যেমন টিউমার বা প্যানক্রিয়াটাইটিস, তা হলে পোস্ট-হেপাটাইটিক জন্ডিস হতে পারে। গিলবার্টস সিনড্রোম নামে লিভারের এনজ়াইমের এক ধরনের সমস্যা থেকেও জন্ডিস হতে পারে। তবে তা নিয়ে সাধারণত তেমন চিন্তার কোনও কারণ নেই।

বাচ্চাদের মধ্যে মূলত হেপাটাইটিস থেকেই জন্ডিস হয়ে থাকে। এর মধ্যে প্রধানত থাকে হেপাটাইটিস এ, বি এবং সি। অপরিষ্কার জল বা খাবার থেকে হেপাটাইটিস এ-র সংক্রমণ ঘটতে পারে। অতিরিক্ত বাইরের খাবার খাওয়া বা সঠিক হাইজিন বজায় না রাখার কারণে হেপাটাইটিস এ হতে পারে। হেপাটাইটিস বি রক্তবাহিত অসুখ, অর্থাৎ এর ভাইরাস শুধুমাত্র রক্তের মাধ্যমে একজনের থেকে অন্যজনের শরীরে ছড়ায়, জল বা খাবারের মাধ্যমে নয়। মায়ের শরীরে এই রোগের ভাইরাস থাকলে বাচ্চার জন্মের সময়ে তা বাচ্চার শরীরেও চলে আসতে পারে। হেপাটাইটিস সি-এর জীবাণুও আক্রান্ত ব্যাক্তির রক্তের মাধ্যমে অন্য কারওর শরীরে প্রবেশ করতে পারে। হেপাটাইটিস এ এবং বি-র ভ্যাকসিন পাওয়া যায়। ঠিক সময়ে বাচ্চাকে অবশ্যই এই দুটি রোগের ভ্যাকসিন দিয়ে দিন।

লক্ষণ ও রোগ নির্ণয়:

জন্ডিস হলে বাচ্চা খেতে চায় না। চোখ, হাত-পায়ের তালু, মুখমণ্ডল ও শরীরের অন্যান্য অংশ হলুদ হয়ে যায়। স্টুল এবং ইউরিনের রঙেও পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। ইউরিন অস্বাভাবিক রকম হলুদ হয়ে যায়। স্টুলের রংও অনেক সময় সাদা হয়ে যেতে পারে। এ ছা়ড়া পেটব্যথা, অবসাদ বা জ্বরও জন্ডিসের অত্যন্ত পরিচিত লক্ষণ। যদি মস্তিষ্কে কোনওভাবে এর প্রভাব পড়ে, তা হলে বাচ্চার বমি হতে পারে এবং বাড়াবাড়ি হলে বাচ্চা জ্ঞানও হারাতে পারে।

জন্ডিস নির্ণয় করার জন্য ডাক্তাররা প্রাথমিকভাবে লিভার ফাংশন টেস্ট করানোর পরামর্শ দেন। প্যানক্রিয়াটাইটিস সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য অ্যামাইলেজ় লাইপেজ় টেস্ট করানো হয়। ব্লাড কাউন্ট পরীক্ষা করে দেখতে হতে পারে। যদি ডাক্তারের মনে হয় শরীরে কোথাও কোনও অবসট্রাকশন তৈরি হয়েছে এবং তার কারণে জন্ডিস হয়েছে, তা হলে আলট্রাসোনোগ্রাফি করে দেখে নেওয়া হয়।

চিকিৎসা:

জন্ডিসের কারণ অনুযায়ী তার চিকিৎসার ধরন বদলে যায়। হেপাটাইটিস এ থেকে জন্ডিস হলে যেভাবে চিকিৎসা করা হয়, হেপাটাইটিস বি-র ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। লেপ্টোস্পাইরোসিসের মতো ব্যাকটিরিয়াল ইনফেকশন থেকে জন্ডিস হলে আবার তার চিকিৎসা ভিন্ন। সেক্ষেত্রে সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। অ্যানিমিয়ার কারণে জন্ডিস হলে আয়রন ট্যাবলেট দিতে হতে পারে। তবে জন্ডিসে খুব প্রয়োজন না হলে যথাসম্ভব কম ওষুধ প্রেসক্রাইব করা হয়। আসলে হেপাটাইটিস থেকে জন্ডিস হলে লিভার ঠিকমতো কাজ করে না। এদিকে বেশিরভাগ ওষুধই লিভারে মেটাবলাইজ়ড হয়। সুতরাং বেশি ওষুধ খেলে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। জন্ডিসের প্রধান চিকিৎসা হল বিশ্রাম এবং সঠিক খাওয়াদাওয়া।

মোটের উপর কয়েকটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে। বাচ্চাকে বেশি করে জল খাওয়ান। খেয়াল রাখবেন, বাচ্চা যেন ডিহাইড্রেটেড না হয়ে যায়। শরীরের সোডিয়াম-পটাশিয়াম ব্যালেন্সটাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। সেটা অবশ্য ডাক্তারই পরীক্ষা করে দেখে নেবেন। বাচ্চাকে সঠিক হাইজিন বজায় রাখতে শেখান। একসঙ্গে অনেকটা খাবার না খাইয়ে কিছুক্ষণ অন্তর বারবার খাবার খাওয়ান। একসঙ্গে বেশি খেয়ে ফেললে বমি হয়ে যেতে পারে। জন্ডিসের উপসর্গের তীব্রতা বেশি থাকলে প্রোটিনযুক্ত কম দিন। তেল বা ফ্যাটযুক্ত খাবারও বেশি চলবে না। সাধারণত মোটামুটি দু’সপ্তাহ এই ডায়েট চালিয়ে যেতে বলা হয়। শরীরে বিলিরুবিনের মাত্রা স্বাভাবিক হয়ে এলে জন্ডিসের উপসর্গ নিজে থেকেই বিদায় নেয়।

 

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Back to top button