স্বাস্থ্য

শিশুর খিঁচুনি বা মৃগী রোগ

মস্তিষ্ক-কোষ বা নিউরনের তড়িৎ বেগের (Electric discharge) অস্বাভাবিকতার কারণে যে কোনো ধরনের ক্ষণস্থায়ী শারীরিক প্রতিক্রিয়া বা বাহ্যিক লক্ষণকে খিঁচুনি বলে। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে দুই বা ততোধিকবার খিঁচুনি হয় তাহলে এটিকে মৃগীরোগ (Epilepsy) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

মৃগীরোগ স্নায়ুতন্ত্রের একটি দীর্ঘস্থায়ী জটিল রোগ। যে কোনো বয়সের পুরুষ ও নারী এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে বাচ্চাদের এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

অনেক ধরনের খিঁচুনি রোগ হয়। যেমন- সারা শরীরে খিঁচুনি বা জেনারেলাইজড এপিলেপ্সি, শরীরের কোন দিকের খিঁচুনি বা ফোকাল এপিলেপ্সি, শরীরের এক জায়গা থেকে শুরু হয়ে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে যাওয়া খিঁচুনি, তবে শিশুদের ক্ষেত্রে সিনড্রোম আকারে খিঁচুনি রোগ আসতে পারে।

কারণ : পরিবারে এরকম ইতিহাস থাকলে, গর্ভকালীন জটিলতা- জন্মের সময় অতিমাত্রায় ওজনের স্বল্পতা, জন্মের পরই শিশুর শ্বাস নিতে দেরি হওয়া/কান্না করতে দেরি হলে। গর্ভকালীন সময়ে মাথার আঘাতজনিত কারণে, জন্মের পরই জন্ডিসের মাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার জন্যও এ রোগ হয়ে থাকে, ছোট বেলায় কোনো কারণে মস্তিষ্কে ইনফেকশনের কারণে পরে খিঁচুনি হতে পারে। অনেক অজানা কারণেও খিঁচুনি হতে পারে।

প্রায় ৩০-৪০ ভাগ শিশুর খিঁচুনি রোগের চিকিৎসা হয় ফকির, কবিরাজ (ট্রাডিশনাল হিলার) দ্বারা। ওষুধ দিয়ে ৭০-৮০ ভাগ রোগীর খিঁচুনি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। বাজারে অনেক ধরনের খিঁচুনি রোগের ওষুধ রয়েছে যেমন- ফেনোবারবিটল, ফেনিটয়েন, ভ্যালপ্রোয়েট ইত্যাদি ওষুধসমূহ প্রায় সব ধরনের খিঁচুনি রোগের জন্যই কার্যকরী।

এসব ওষুধের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। বর্তমানে নতুন ধরনের খিঁচুনিরোধক যে ওষুধ বাজারে এসেছে সেগুলো অধিকতর কার্যকরী এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কম। এসব ওষুধ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খেতে হবে।

খিঁচুনি রোগ নিরাময়ে বাধা হিসাবে দেখা গেছে : কুসংস্কার, অসচেতনতা, ওষুধের স্বল্পতা, ডাক্তার এর স্বল্পতা, অধিক দামের ওষুধ।

খিঁচুনি রোগীর জন্য উপদেশ, যেমন- রোগীকে নিয়মিত ও নির্দিষ্ট সময়ে ওষুধ খাওয়ানো, জ্বর, ঠাণ্ডা, কাশি খিঁচুনিকে বাড়িয়ে দিতে পারে তাই জরুরিভিত্তিতে চিকিৎসা করানো, আগুন এবং পানি থেকে এ ধরনের শিশুদের দূরে রাখা, পুকুরে ডুব দিয়ে গোসল করতে না দেয়া, বাসায় বাথরুমে গোসল করলে দরজা লক না করা (ছিটকানি বন্ধ না করা)। এই রোগের ওষুধ কমপক্ষে ২-৩ বছর খিঁচুনি বন্ধ থাকলে (Seizure free) তবেই বন্ধ করা যেতে পারে (চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী)। এ রোগীদের একটা কার্ড ব্যবহার করা যেতে পারে (কার্ডের মধ্যে রোগীর নাম, রোগের নাম, ওষুধের নাম ও পরিমাণ এবং পূর্ণ ঠিকানা উল্লেখ করতে হবে)। রাতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে এমন কিছু করা যাবে না। যেমন- টেলিভিশন দেখা, মোবাইল দেখা ইত্যাদি।

প্রতিরোধ : শিশুর জন্মের পূর্বে গর্ভাবস্থায় মাকে নিয়মিত ডাক্তারের চেকআপ করানো, গর্ভকালীন জটিলতা দূর করার জন্য ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে প্রসব করানো, পরিবারে এ ধরনের ইতিহাস থাকলে নিয়মিত চেকআপ করা ইত্যাদি।

কখনও কখনও খিঁচুনি রোগীকে হাসপাতালে নেয়ার প্রয়োজন হতে পারে, খিঁচুনি যদি ৫ মিনিটের বেশি স্থায়ী হয়। এক নাগাড়ে অনেকক্ষণ খিঁচুনি চলতে থাকে। একবার খিঁচুনির পর জ্ঞান না ফিরে। বার বার খিঁচুনি হওয়া এবং মারাত্মক খিঁচুনি যদি ওষুধ দিয়েও নিয়ন্ত্রণে না থাকে।

জরুরি অবস্থায় উপদেশ : জোরপূর্বক দাঁত খোলার চেষ্টা না করা। শর্ট বা টাইট কাপড় পরা থাকলে ঢিলা করে দেয়া। সম্ভব হলে রোগীকে নিরাপদ স্থানে নেয়া। রোগীর পাশে থাকা আগুন, পানি, ধারালো জিনিস সরিয়ে ফেলা। রোগীকে পানি পান করানোর চেষ্টা না করা। রোগীর শরীরে বাতাস করা অথবা ফ্যান এর ব্যবস্থা করা। খিঁচুনি আক্রান্ত ব্যক্তির চারদিকে ভিড় না করা।

বেশির ভাগ খিঁচুনি হঠাৎ শুরু হয় এবং নির্দিষ্ট সময় পর থেমে যায়।

বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট

* বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে ১.৫-২ মিলিয়ন খিঁচুনি রোগী রয়েছে।

* সম্প্রতি বাংলাদেশে মৃগী রোগ বিষয়ে একটি জাতীয় পর্যায়ের গবেষণা হয়েছে। ফলাফল অনুযায়ী বাংলাদেশে শিশুদের ক্ষেত্রে (১-১৭ বছর) মৃগী রোগী ১১.৫/১০০০ জন এবং বড়দের ক্ষেত্রে সেটি ৭.৫/১০০০ জন। এই সংখ্যা মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের মধ্যে বেশি।

* সঠিক চিকিৎসায় এ রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

* রোগীর স্কুলে যেতে বাধা নেই।

* এ রোগ ছোঁয়াচে নয়, তাই এ রোগীর বাড়িতে যেতে বাধা নেই।

* জগতে বিখ্যাত অনেক মানুষ যাদের মধ্যে আর্টিস্ট ভিনসেন্ট ভ্যানগগ, বিজ্ঞানী সক্রেটিস, সাহিত্যিক চার্লস ডিকেন্স এ রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তারা তাদের কাজের মধ্যে দিয়ে খিঁচুনি রোগকে জয় করতে পেরেছেন।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button