বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

লাইক পাবেন কয়টা? যা ভাবছে ফেসবুক

অনেকে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েই লাইক গুনতে থাকেন। একটু পর পর মোবাইল খুলে দেখতে থাকেন নোটিফিকেশন! বারবার লাইক দেখাটা আপাতদৃষ্টে নিরীহ মনে হলেও এটা কিন্তু একধরনের নেশা! ফেসবুকও বিষয়টা নিয়ে বেশ চিন্তিত। কেন এমন হয়? সমাধান বা কী?

ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মেলিসা হান্ট বারবার লাইক গণনার পেছনে দুটি কারণকে দায়ী করেন। একটি হলো তুলনা করা। ব্যবহারকারী স্বভাবতই নিজেকে তার বন্ধুর সঙ্গে তুলনা করতে চায়, তাই তার পোস্টে লাইক কত হলো, তার বন্ধুর চেয়ে বেশি হলো কি না এ নিয়ে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়। ফলে শুরু হয় বারবার লাইক গোনার অভ্যাস। আরেকটি কারণ হলো ‘না জানার ভয়’! যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিটি মুহূর্তেই কিছু না কিছু হচ্ছে। অনেকের মধ্যেই না জানার এক গোপন ভয় কাজ করে। ফলে সেই ভীতি কাটাতে গিয়ে তারা মনের অজান্তেই নোটিফিকেশন দেখতে থাকে। সেই সঙ্গে চলে লাইক সংখ্যা তুলনার অসুস্থ অভ্যাস।

কিছু গবেষণার ফলাফল
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবাই চায় নিজেকে ভালোভাবে প্রকাশ করতে। এখানে যে কেউই আবির্ভূত হতে পারে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ হিসেবে, যেটা হয়তো সব সময় বাস্তব না-ও হতে পারে। তাই ফেসবুক ব্যবহারকারী তার বন্ধুদের নানা পোস্ট দেখে স্বভাবতই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়, সেগুলোর সঙ্গে নিজেকে তুলনা করতে থাকে। ফলে চলে আসে ঈর্ষা এবং শুরু হয় এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা—ঠুনকো চাকচিক্য দিয়ে নিজেকে সবচেয়ে সুখী হিসেবে প্রকাশ করার ইঁদুরদৌড়! সেই সঙ্গে চলতে থাকে অন্যের পোস্টের সঙ্গে নিজের পোস্টের লাইকের সংখ্যাগত তুলনা। এসব মনমতো না হলে জন্ম নেয় হতাশা ও প্রবল একাকিত্ব।

‘জার্নাল অব অ্যাপ্লায়েড বিহেভিওরাল রিসার্চ’-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় ৫০৪ জন তরুণ-তরুণীর ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম এবং স্ন্যাপচ্যাটে কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, মেজর ডিপ্রেশন ডিসঅর্ডারে ভোগা ব্যবহারকারীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আসক্তি ক্ষেত্রে বেশি নম্বর পেয়েছে।

‘জার্নাল অব সোশ্যাল অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি’তে প্রকাশিত ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার মনোচিকিৎসকদের আরেকটি গবেষণায় হতাশার সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের সম্পর্ক উঠে এসেছে। এ গবেষণায় ১৪৩ জন শিক্ষার্থীকে পর্যবেক্ষণের ফলাফল সম্পর্কে সেই বিশ্ববিদ্যালয়েরই অধ্যাপক মেলিসা হান্ট বলেন, ‘তিন সপ্তাহের গবেষণায় দেখা গেছে, যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের উপস্থিতি কমাতে পেরেছে, তাদের হতাশা ও একাকিত্ববোধ অনেকটাই কমে গেছে।’

আরেকটি সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, তরুণ-তরুণীরা পোস্টের লাইক দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত। যে পোস্টে বেশি মানুষ লাইক দিয়েছে, সেখানেই তারা বেশি সময় ব্যয় করেছে। একইভাবে সবচেয়ে খারাপ বোধ করে, যখন তাদের পোস্টটা লাইক, কমেন্টের দিক দিয়ে সে রকম মনোযোগ কেড়ে নিতে পারে না।

কী ভাবছে ফেসবুক?
লাইক গণনার অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা এবং তা থেকে সৃষ্ট মানসিক জটিলতার কথা চিন্তা করে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের লাইক সংখ্যা তাদের বন্ধুদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখার পরিকল্পনা করছে। এতে পোস্টটিতে কয়টি লাইক পড়ল এবং কে কে লাইক দিল তা ব্যবহারকারী নিজে জানতে পারলেও জানতে পারবে না তার বন্ধুরা। আরএসপিএইচ এবং ইয়াং হেলথ মুভমেন্টের ২০১৭ সালের একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে ফেসবুকের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সাইট ইনস্টাগ্রাম। বিগথিংকের তথ্যমতে, ইনস্টাগ্রাম এরই মধ্যে সাতটি দেশে পরীক্ষামূলকভাবে লাইক সংখ্যা লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা শুরু করেছে। সেখানে কে কে লাইক দিল সবার নাম না দেখিয়ে কিছু মিউচুয়াল ফ্রেন্ডের নাম দেখানো হবে। এ ব্যবস্থা ইনস্টাগ্রামে সফল হলে খুব শিগগিরই তা ফেসবুকেও চালু হয়ে যাবে। ফেসবুক মনে করে এই পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে কমবে পরশ্রীকাতরতা, সেই সঙ্গে কমে যাবে চাপ ও মানসিক সমস্যাও।

কিভাবে বের হওয়া যাবে এ দুষ্টচক্র থেকে?
লাইক লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা চালু হতে ফেসবুকের এখনো বেশ খানিকটা সময় লাগবে। তা ছাড়া নিজেরা সচেতন না হলে লাইক লুকিয়ে রাখলেও খুব একটা কাজ হবে না। কিছু সহজ বিষয় মাথায় রাখলেই কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে গঠনমূলক উপায়ে ব্যবহার করা যায়। এ জন্য প্রথমত নিউজফিডে সবার স্ট্যাটাস দেখার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। নিজের পছন্দমতো পোস্ট পেতে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় পেজগুলোতে লাইক দিয়ে সি ফার্স্ট দিয়ে রাখুন। এতে সব সময় আপনার প্রিয় পোস্টগুলোই ওপরে দেখতে পাবেন। তা ছাড়া নিউজফিডটিকে আরো সুন্দর করতে আনফলো অপশনটিও বেশ কাজের। এতে যার পোস্ট দেখতে চান না সেগুলো আর হাজির হবে না। এভাবে একটা সুন্দর, গঠনমূলক ওয়েব স্পেস তৈরি হবে। এ সেবাগুলো একসঙ্গে পেতে চলে যান ফেসবুকের সেটিংস অ্যান্ড প্রাইভেসিতে থাকা ‘ইয়োর টাইম অন ফেসবুক’ অপশনটিতে। সেখান থেকেই কার কার পোস্ট সবার আগে দেখবেন তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো, সেখান থেকে ফেসবুকে প্রতিদিন কতটুকু সময় ব্যয় করছেন সে সম্পর্কেও অবগত হতে পারবেন। আর সেখানে ফেসবুক ব্যবহারের সময় বেঁধে দেওয়ার সুবিধাও থাকছে। ‘সেট ডেইলি টাইম রিমাইন্ডার’ অপশনটিতে গিয়ে সময় নির্ধারণ করে দিলে ফেসবুক নিজে থেকেই আপনাকে সময় শেষ হয়েছে বলে জানিয়ে দেবে। নোটিফিকেশন সেটিংসটাও পরিবর্তন করে রাখা ভালো। এতে ফেসবুক হুটহাট শব্দ করে আপনার মনোযোগে বিঘ্ন ঘটাবে না। অপশনটি ‘ইউর টাইম অন ফেসবুক’-এ পাবেন।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Back to top button