লিড নিউজ
সাত দিনে ভর্তি ১৫০১ রোগী
দেশে করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণের মধ্যেই এখন ভয়ঙ্কর রূপ নিতে শুরু করেছে ডেঙ্গু জ্বর। এখনও পর্যন্ত ঢাকা শহরেই মূলত এর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে শিশুরা। আর রোগীর চাপ বাড়ছে ঢাকার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। তবে করোনা মহামারির এই সময়টায় হাসপাতালের ধকল এড়াতে মশা থেকে সুরক্ষিত থাকতে বলছেন চিকিৎসকরা। দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৬৪ জন, যা চলতি বছরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক ডেঙ্গু রোগীর রেকর্ড। আর গত সাত দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৫০১ জন।
চিকিৎসকরা বলছেন, গত কয়েকদিন ধরে এডিস মশাবাহিত এই ভাইরাস জ্বরে যেভাবে আক্রান্ত রোগী বাড়ছে, তাতে অনেক শিশুও পাওয়া যাচ্ছে। তারা বলছেন, ডেঙ্গুর ভয়াবহতা শিশুদের সহ্য করা অত্যন্ত কঠিন। বড়দের শারীরিক যে সহনীয় ক্ষমতা আছে, শিশুদের তা নেই। এ কারণে তাদের জন্য ডেঙ্গু অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় শিশুদের প্রতি বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ তাদের।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শেষ পর্যায়ে রোগী আসায় ঝুঁকি আরও বাড়ছে। আর করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই পরিস্থিতিতে রোগ নির্ণয়ে দেরি হওয়ায় ডেঙ্গু রোগীদের বেশি ভুগতে হচ্ছে। অন্যদিকে দুই সিটি করপোরেশন ডেঙ্গু জ্বরের বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করলেও প্রতিদিন রেকর্ডসংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। চলতি বছরে সর্বোচ্চসংখ্যক ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে গত জুলাই মাসে। এরপর আগস্টের তিন দিনে ৭৮৮ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছেন ২৬৪ জন। এদের মধ্যে ২৪৮ জনই ঢাকার, আর ঢাকার বাইরের ১৬ জন। মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দেওয়া তথ্যে এসব জানা গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ১ হাজার ৭২ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। এর মধ্যে ঢাকাতেই আছেন ১ হাজার ২৫ জন, আর বাকি ৪৭ জন ঢাকার বাইরে অন্যান্য বিভাগে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত ৩ হাজার ৪৪৬ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। একই সময়ে তাদের মধ্যে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ছাড়প্রাপ্ত পেয়েছেন ২ হাজার ৩৭০ জন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য মতে, গত সাত দিনে অর্থাৎ গত ২৮ জুলাই দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন ১৫৩ জন। এর মধ্যে ঢাকাতেই ১৫০ জন। আর ঢাকার বাইরে ৩ জন।
২৯ জুলাই ভর্তি হওয়া ১৯৪ জনের মধ্যে ঢাকায় নতুন ১৮১ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন বিভাগ এবং জেলায় ১৩ জন। ৩০ জুলাই ভর্তি হয় ১৭০ জন, এর মধ্যে ঢাকাতেই ১৬৪ জন। আর ঢাকার বাইরে রয়েছেন ছয়জন। ১৯৬ জন ভর্তি হন ৩১ জুলাই, যার ১৯৪ জনই ঢাকায়। আর ঢাকার বাইরের রয়েছেন ২ জন। ১ আগস্ট ২৩৭ জন। এর মধ্যে রয়েছেন ঢাকায় ২১৮ জন। আর ঢাকার বাইরের রয়েছেন ১৯ জন। ২ আগস্ট ভর্তি হওয়া ২৮৭ জনের ঢাকাতেই ২৭৯ জন। আটজন ঢাকার বাইরে। এ ছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছেন ২৬৪ জন। এদের মধ্যে ২৪৮ জনই ঢাকার, আর ঢাকার বাইরের ১৬ জন। মোট সাত দিনে ১ হাজার ৫০১ জন রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
ঢাকা শিশু হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া প্রায় ১০০ শিশুর মধ্যে এখন পর্যন্ত মারা গেছে চারজন। এই হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্তদের অধিকাংশই পাঁচ বছরের কম বয়সি। হাসপাতালের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জ্বর, মাথাব্যথা, চোখে ব্যথা, শরীরে ব্যথা, মুখ থেকে রক্তক্ষরণ, পেট ফুলে যাওয়া, শরীরে পানি আসা, গায়ে র্যাশ ওঠাÑ এসব লক্ষণ নিয়ে শিশুরা হাসপাতালে আসছে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের এক চিকিসৎক নাম না প্রকাশ করার শর্তে সময়ের আলোকে বলেন, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর শরীরে উচ্চ তাপমাত্রার পাশাপাশি হাড় ও মাংসপেশিতে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। বড়দের তুলনায় শিশুরা পানিশূন্যতায় বেশি ভোগে। এতে তীব্র পানিশূন্য হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়াসহ নানা জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয় শিশুদের।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে করোনা রোগীর জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই। করোনা রোগীদের এখানে ভর্তির সুযোগ নেই। এ কারণে এখানে অন্যান্য রোগীর চাপ বাড়ছে। বিশেষ করে ডেঙ্গু রোগীর চাপে এখন হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। গত এক সপ্তাহে হাসপাতালটিতে পাঁচ শতাধিক ডেঙ্গু রোগীকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়েছে। রোগী সামাল দিতে মঙ্গলবার থেকে নতুন ওয়ার্ড চালু হয়েছে।
এ হাসপাতালে কথা হয় পুরান ঢাকার বাসিন্দা আহমেদ সাইফের সঙ্গে। তার ভাই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। তিনি বলেন, গত চার দিন ধরে এখানে আমার ভাই ভর্তি আছে। শ্বাস-প্রশ্বাসেরও সমস্যা আছে। মহামারির মধ্যে ভাইকে নিয়ে খুবই দুচিন্তায় আছি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র ও লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, দেশের করোনা পরিস্থিতি এখন ঊর্ধ্বগামী। এ অবস্থায় ডেঙ্গু পরিস্থিতিরও যদি অবনতি হয়, তা হলে আমাদের পক্ষে সামাল দেওয়া কঠিন হবে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণেও জ্বর যেমন হয়, ডেঙ্গুতেও তাই হয়। করোনাভাইরাস আর ডেঙ্গুর জোড়া প্রকোপে ব্যাপক মৃত্যু ঠেকাতে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা ও এডিস মশার বংশ বিস্তার থামাতে জোর দিতে হবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো. দেলোয়ার হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, আমরা জানি এডিস মশা মূলত দিনের বেলায় কামড় দেয়। তাই দিনের যেকোনো সময় ঘুমালেও মশারি টানিয়ে ঘুমাতে হবে। তারপরও যদি কারও জ্বর হয় তা হলে করোনা পরীক্ষার পাশাপাশি ডেঙ্গু পরীক্ষাও করতে হবে।
শিশুরা এ সময়ে বেশি আক্রান্তÑ এ ব্যাপারে তিনি বলেন, বড়দের সঙ্গে শিশুদের ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ-উপসর্গে কিছু অমিল আছে। ছোট্ট শিশুদের ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলো শুরু হয় আর দশটা সাধারণ ভাইরাস জ্বরের মতোই। খাবারে অরুচি, বমি ভাব বা বমি, পায়ে-হাতে চুলকানিও হতে পারে। যেহেতু ছোট শিশুরা কথা বলতে পারে না। তাই তাদের প্রতি অধিক যত্নশীল হওয়া জরুরি।