জাতীয়রাজনীতিলিড নিউজ

রতনের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ

কত সম্পদের মালিক এমপি রতন? দুদকের অনুসন্ধান শুরুর খবর প্রকাশের পর এটিই এখন সুনামগঞ্জের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। এলাকার মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে নানা কথা।

মোয়াজ্জেম হোসেন রতন আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সুনামগঞ্জ-১ আসনের নির্বাচিত সংসদ সদস্য। ধর্মপাশা-জামালগঞ্জ, তাহিরপুর ও মধ্যনগরজুড়ে গতকাল তাই ঘুরেফিরে আলোচিত হয়েছে এই এমপির ক্যাসিনোকাণ্ডের মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিষয়টি। দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেই পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা হয়েছে। এমপি রতন কীভাবে শূন্য থেকে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন- সে প্রশ্ন উঠেছে বারবার। জানা গেছে, চলতি মাসের শুরুতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের অর্ধশতাধিক নেতার স্বাক্ষরে এমপি রতনের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগনামা দেওয়া হয়েছে। সেখানে তার বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াত নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়া, জামালগঞ্জ খেয়াঘাটে বেপরোয়া চাঁদাবাজির অভিযোগ করা হয়েছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মোয়াজ্জেম হোসেন রতন।

এমপি রতনের কত সম্পদ :জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রেজাউল করিম শামীম বলেন, পুরো নির্বাচনী এলাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুর্নীতিবিরোধী অভিযান প্রশংসিত হচ্ছে। এই এলাকার এমপির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে ধরে তিনি বলেন, বিগত সময়ে সরকারি বরাদ্দের ১০ শতাংশও নির্বাচনী এলাকায় ব্যয় হয়নি। ৯০ ভাগেরও বেশি অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে বালু-পাথরমহাল এবং নদীপথে চাঁদাবাজিতে তার ইন্ধন রয়েছে। দুদক অনুসন্ধান করলেই এসব বিষয়ের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবে।

ধর্মপাশার এক আওয়ামী লীগ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সংসদ সদস্য হওয়ার পরই মূলত আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। এখন তিনি বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক। এটা তার প্রকাশ্য আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। নামে-বেনামে ও আত্মীয়স্বজনের নামে তার অনেক সম্পদ রয়েছে। নেত্রকোনা পৌরসভা এলাকায় রয়েছে ১৫ একর জমি। মাত্র কয়েক দিন আগে তিনি সুনামগঞ্জ শহরে পুলিশ লাইনের পাশে সাত কোটি টাকা দিয়ে বাড়িসহ জায়গা কিনেছেন। নিজ গ্রাম ধর্মপাশায় নির্মাণ করেছেন ‘স্বর্ণমহল’ নামে একটি বিলাসবহুল বাড়ি, যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। এ ছাড়া ধর্মপাশা হাসপাতালের পাশে ৬০ শতাংশের ওপর রয়েছে আরেকটি বাড়ি। সুনামগঞ্জের বাইরে আশুলিয়ায় রয়েছে আট কাঠা জমি। ধর্মপাশার নওধারে একজন অসহায় নারীর জমি দখল করে বাড়ি নির্মাণের অভিযোগও রয়েছে এমপি রতনের বিরুদ্ধে। তার ভাই যতন মিয়ার নামে গত কয়েক বছরে প্রায় ৫০০ একর জমি কেনা হয়েছে। এমপির নিজের নামেও গত কয়েক বছরে অনেক দাম দিয়ে কেনা হয়েছে প্রায় ৬০ একর জমি। এ ছাড়া তিনি তার বাবা ও মায়ের নামে রাবেয়া-রশিদ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপনের জন্য নেত্রকোনায় জমি কিনেছেন।

সিলেটের আরেক আওয়ামী লীগ নেতা জানান, এমপি রতন সিলেটে একজন ব্যবসায়ীর বাড়িতে লজিং থাকতেন। সে সময়ে তিনি তার ফোন-ফ্যাক্সের দোকানের তদারকির দায়িত্ব পাওয়ার পর টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে যান বলে অভিযোগ রয়েছে। এরপর তিনি বিটিসিএলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল অর্থের মালিক হন। তিনি নবম জাতীয় সংসদে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। এ সময়ও তার বিরুদ্ধে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার অভিযোগ ছিল। এই নেতা আরও জানান, কেবল অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার বিষয়ে যথাযথ তদন্ত হলে তার অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনের প্রকৃত চিত্র উদ্‌ঘাটিত হবে।

নেতাকর্মীদের যত অভিযোগ :চলতি মাসের শুরুতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে দেখা করে সুনামগঞ্জ-১ নির্বাচনী এলাকার প্রায় অর্ধশত নেতা একটি দীর্ঘ অভিযোগনামা জমা দেন। সেখানে তারা উল্লেখ করেন, এলাকায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচিত হলেও এমপি রতন বিএনপি-জামায়াত নেতাদের একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে জামালগঞ্জ কলেজে উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রফিকুল বারী রফিককে অধ্যক্ষ হিসেবে, ভীমখালি উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হিসেবে স্থানীয় বিএনপি নেতা দুলাল মিয়াকে, জামালগঞ্জের তালিকাভুক্ত রাজাকার নজির আলীকে অষ্টগ্রাম মাদ্রাসার সভাপতি হিসেবে ও আলাউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি হিসেবে ফেনারবাঁক ইউনিয়ন বিএনপির বর্তমান সভাপতি তৌফিক চৌধুরীকে নিয়োগ দেওয়া। এভাবে ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের পরিচালনা পর্ষদে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ তোলা হয়।

ওই অভিযোগনামায় আরও বলা হয়, জামালগঞ্জ সাচনা খেয়াঘাট উপজেলা বিএনপি নেতা শাহজাহানকে ইজারা দিয়ে উচ্চ হারে টোল আদায়ের নামে চাঁদাবাজি চলছে। এর নেপথ্যে রয়েছেন এমপি রতন। গত বন্যায় এলাকার কোনো দুর্গত মানুষকে এমপি দেখতে যাননি এবং এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত কেউই কোনো ধরনের ত্রাণ পাননি।

নির্বাচনী হলফনামায় যা বলেছেন এমপি রতন :নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এমপি রতন যে হলফনামা দিয়েছিলেন, সেখানে তিনি তার নিট বার্ষিক আয়ের পরিমাণ দুই কোটি ১৬ লাখ ৮৪ হাজার ৮৪৬ টাকা উল্লেখ করেন। আর বার্ষিক ব্যক্তিগত ব্যয়ের পরিমাণ উল্লেখ করেন তিন লাখ ৯৫ হাজার ১৫২ টাকা। ধর্মপাশা ও আশুলিয়ায় কমবেশি ৫ দশমিক ৮ একর জমি থাকার কথা উল্লেখ করেন। পেশায় নিজেকে উল্লেখ করেন ডিপ্লোমা প্রকৌশলী হিসেবে।

অন্যদিকে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় দেওয়া হলফনামায় ৫২৩ দশমিক ২৭ একর কৃষিজমি, ৮ দশমিক ২৬ একর পরিমাণ অকৃষিজমি, একটি অ্যাপার্টমেন্ট এবং নিজের মালিকানা ও অংশীদারিত্বের তিনটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকার কথা উল্লেখ করেন।

এমপির বক্তব্য :নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে এমপি রতন বলেন, ক্যাসিনোর ভেতরে কী হয়, আমি জানি না। আমার চৌদ্দগুষ্টির কেউ এ বিষয়ে জানে না। যারা এই অপবাদ দিচ্ছে, আমি গণমাধ্যমকর্মীদের মাধ্যমে তাদের বিচার চাই। তিনি আরও বলেন, এমপি হওয়ার আগেই তার অনেক সম্পদ ছিল, আয়কর ফাইলেও এগুলোর উল্লেখ রয়েছে। এমপি হওয়ার আগেই নেত্রকোনা, মোহনগঞ্জ, ধর্মপাশায় তার বাড়ি ছিল। সুনামগঞ্জেও বাড়ি রয়েছে। যারা ওই আসনে এমপি হওয়ার স্বপ্ন দেখে, তারা ঈর্ষান্বিত হয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তিনি দাবি করেন, তার সব সম্পদ সাদা, তিনি জীবনে কখনও কারও সঙ্গে প্রতারণা করেননি কিংবা অবৈধপথে কোনো উপার্জন করেননি। এমপি রতন আরও বলেন, অভিযোগ থাকলে সে ব্যাপারে তদন্ত হবে, অনুসন্ধান হবে। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে শাস্তিও হবে। কিন্তু যদি অভিযোগ সত্যি না হয়, তাহলে অভিযোগকারীর শাস্তি হওয়া দরকার।

এমপির পক্ষে বক্তব্য :এদিকে, এমপি রতনের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ধর্মপাশা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমদ বিলকিস বলেন, এমপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার হচ্ছে। যেমন- কোনো কোনো ওয়েবপোর্টালে ছাপা হয়েছে তিনি ১০টি গার্মেন্ট কারখানার মালিক। অথচ তার একটি কারখানাও নেই। মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হওয়ার অভিযোগও সত্য নয়। আগে নদীপথে বা যাদুকাটা বালু-পাথরমহালে যে চাঁদাবাজি হয়েছে, তা এমপি রতনই দমনের চেষ্টা করেছেন। তার ব্যক্তিগত সহকারীরা চাঁদাবাজিতে যুক্ত হওয়ায় তিনি তাদের বরখাস্ত করেছেন। সরকারি বরাদ্দের টাকা আত্মসাতের অভিযোগও মিথ্যা। মোয়াজ্জেম হোসেন রতনকে নির্বাচনী এলাকায় উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে উল্লেখ করেন শামীম।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button