জাতীয়

সম্রাটের সহযোগী চাঁদপুরের সেলিম খানের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে দুদক

কণিকা অনলাইন :

চাঁদপুর সদরের ১০নং লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সেলিম খানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) দুদক কমিশন এই সিদ্ধান্ত নেয় বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।

সেলিম খানের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ আসে, চাঁদপুর সদরের লক্ষ্মীপুর মডেল ইউপির বহরিরা বাজার এলাকার গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের ১ তলার ১০০টি ভবন নির্মাণে নিম্নমানের কাজকরণ ও ঘর বরাদ্দকালে প্রতিটি ঘর থেকে ১০-১৫ হাজার ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে কোটি কোটি টাক আত্মসাৎ করেছেন তিনি।

এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) চাঁদপুর সদরের লক্ষ্মীপুর মডেল ইউপির বহরিরা বাজার এলাকার গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পে দুদকের একটি টিম অভিযান চালায়।

দুদকের কুমিল্লা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক রাফি মো. নাজমুস সাদাৎ-এর এই অভিযান চালানো হয়।

অভিযানকালে দুদক টিম সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে ওই প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে বলে সত্যতা পায় দুদক।

গত সেপ্টেম্বর মাসে অনুসন্ধানে জানা যায়, চাঁদপুরের লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের এই চেয়ারম্যান সেলিম খান ক্যাসিনোকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের অন্যতম সহযোগী। সম্রাটের ছায়াতলে থেকে অবৈধভাবে তিনি নামে-বেনামে অঢেল সম্পদ গড়ে তুলেছেন।

এছাড়াও সেলিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, নিজ এলাকায় সরকার থেকে দুস্থদের জন্য ঘর বরাদ্দে ঘুষ নিয়েছেন তিনি এবং বেআইনিভাবে প্রকল্প এলাকার সন্নিকটে নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছেন।

চাঁদুপুরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যালয় করার ঘোষণা দিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমির কথা বলে বিভিন্ন মানুষের প্রায় ৫৫ একর জমি দখল করেছেন। এলাকায় ৩ শতাধিক অস্ত্রধারী বাহিনী গড়ে তুলেছেন। এ বাহিনী দিয়ে সেলিম অবৈধ বালু উত্তোলন, জমি দখলসহ নানা অপকর্ম করেন।

এসব অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে এর সত্যতাও পেয়েছেন দুদক কর্মকর্তারা।

সরকারের চলমান শুদ্ধি অভিযানে সেলিম খানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের বেশ কিছু অভিযোগ জমা পড়ে দুদকে।

এছাড়াও সেলিম খানকে অনুপ্রবেশকারী বলে চিহ্নিত করেছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়।

এ বিষয়ে দুদক সূত্র জানায়, চাঁদপুর সদরের লক্ষ্মীপুর ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের একটি অভিযোগ দুদকে জমা পড়ে। কমিশন অভিযোগটি আমলে নিয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অভিযোগ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র সংগ্রহ শুরু করেছে অনুসন্ধান কর্মকর্তা।

দুদকের কাছে করা অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, সেলিম খান তার চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সভাপতি পদের প্রভাব খাটিয়ে নদী থেকে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার বালু উত্তোলন করেন। এর ফলে চাঁদপুরের নদী তীরবর্তী এলাকা ভাঙনের মুখে পড়ে। তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ড নিয়ন্ত্রিত বেড়িবাঁধ খাল দখল করে মাছ চাষ করছেন।

অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, সেলিম খান ২১ কোটি টাকা দিয়ে চাঁদপুর শহরের কালীবাড়ির কাছে জমি কিনেছেন।

ভয়ভীতি দেখিয়ে নামমাত্র মূল্যে অর্থাৎ ১ লাখ টাকা শতাংশের জমি ৫-১০ হাজার টাকায় রেজিস্ট্রি করে নিয়েছেন।

গত পাঁচ বছরে ঢাকাতেও বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন সেলিম খান। সম্রাটের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে কাকরাইলে ৪ তলা আলিশান বাড়ি, ডেমরায় ৬ তলা বাড়ি, রাজধানীর হাতিরপুল ও নারায়ণগঞ্জের ভুঁইগড়সহ বিভিন্ন স্থানে বেনামি সম্পদ রয়েছে।
এছাড়া শাপলা মাল্টিমিডিয়া নামে একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান খুলে সিনেমা তৈরি করতে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন।

কয়েক বছরের ব্যবধানে সেলিম খানের অস্বাভাবিক সম্পদ এলাকাবাসীর কাছে রূপকথার গল্পের মতো।

সরেজমিন তার সম্পদ অর্জনের অনেক অজানা কাহিনী জানা গেছে।

এলাকাবাসীরা জানিয়েছেন, রিকসা চালাতেন এই সেলিম খান। এরপর ছিঁচকে চুরি থেকে সব ধরনের চুরিতে পেশাদার হয়ে ওঠেন সেলিম। গেল বিএনপি সরকারের সময় চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েন সেলিম।

অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান হাফেজ বেপারী সেলিমকে চোর হিসেবে শাস্তি দেন। এলাকার মানুষের দাবির মুখে ওই ইউনিয়ন থেকে তাকে বিতাড়িত করা হয়।

এমন চোর ১০ বছরে কীভাবে এতো সম্পদের মালিক হলো এমন প্রশ্নে এলাকাবাসী জানান, মেঘনা নদীতে শত শত ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বছরের পর বছর বালু তুলে বিক্রি করেই আজ সেলিম খান কোটিপতি।

এলাকাবাসী বলেন, চেয়ারম্যানের নিজের ইউনিয়নটি নদীর পাড়ে। সেখানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথা বলে গরিব দুঃখীদের ফসলি জমি ও ভিটেবাড়ি নামমাত্র মূল্যে গ্রাস করে নিচ্ছেন। চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথা বলে যাদের জমি নিয়েছেন তাদের মধ্যে স্থানীয় সুকা কবিরাজের বাড়িসহ প্রায় ২৫টি বাড়ির শতাধিক পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়েছে।

সুলতান খান, শাহালম খান, জাহাঙ্গীর, মুরাদ উকিলসহ অনেকের সম্পত্তি নামমাত্র মূল্যে কিনে তাদের উচ্ছেদ করার অভিযোগ উঠেছে।

স্থানীয়রা বলেন, তিনি চাইলে জমি দিতেই হবে। না দিলে পরিণতি হবে ভয়াবহ। চেয়ারম্যানের অত্যাচারের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ১০নং লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের এক বাসিন্দা।

তিনি বলেন, আমার ৫৬ শতাংশ জমি জোর করে নিয়ে গেছে। এভাবে সে বহু মানুষের জমি দখল করছে। কিছু বলতে গেলে চলে নির্যাতন।

সেলিম খানের বিষয়ে জানতে চাইলে বর্তমান লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন ও সাবেক সাখুয়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান খান ওরফে মনা খাঁ বলেছিলেন, আমি যতটুকু জানি তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ রয়েছে তা সঠিক। তিনি এক সময় রিকশা চালাতেন। তার বিশাল বিত্তবৈভব নিয়ে আমাদের সবার মাঝে প্রশ্ন আছে। কীভাবে এত সম্পদের মালিক হয়েছেন, তা এলাকার মানুষের কাছে বিস্ময়।

এদিকে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের বিপুল সম্পদের বর্ণনা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

গতমাসে তিনি বলেছিলেন, চেয়ারম্যান সেলিমের সম্পদের বিবরণ শুনে মনে হয়েছে বড় ধরনের অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ-সম্পদ আহরণের একটি দৃষ্টান্ত। এটা পরিষ্কারভাবে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতি। তদন্তের বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনের এখতিয়ার হয়ে যায়। কাজেই আমরা আশা করব, তার ব্যাপারে সঠিক তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সূত্র জানায়, ঢাকার ক্যাসিনো ব্যবসাসহ তদবির বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকার মালিক সেলিম খান। তিনি যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, আরমান ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাঈদসহ চক্রের সঙ্গে মিলে নিজেকে প্রভাবশালীদের তালিকায় নিয়ে যান।

এসব তথ্য ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়েছে। যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা সম্রাটের সঙ্গে তার বেশ কিছু ছবি ভাইরাল হয়েছে।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Back to top button