জাতীয়
৪ বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২ লাখ শিশুর জন্ম
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটছে ব্যাপকহারে। গত ৩ বছর ১১ মাসে ক্যাম্পগুলোতে জন্ম নিয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা শিশু। আর সন্তানসম্ভবা রয়েছেন ২৮ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা নারী। তবে প্রশাসনের দাবি, জন্মনিয়ন্ত্রণে ক্যাম্পে নানা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এজন্য আগের হারে শিশুসন্তান বাড়ছে না।
বিভিন্ন সূত্রের তথ্যমতে, কক্সবাজারের ৩৪টি ক্যাম্পে প্রতিদিন গড়ে জন্ম নিচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ শিশু। এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে পরিষেবা জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে দেশের প্রশাসন। আর ক্রমাগত অপরাধ কাণ্ডে জড়িয়ে পড়া রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। অনিয়ন্ত্রিত এই উচ্চ জন্মহার যেন গোঁদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যেখানে দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ নীতিতে চলমান রয়েছে, ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট এই ধারণা, সেখানে একেকটি রোহিঙ্গা পরিবারের সন্তানের সংখ্যা গড়ে ৫ থেকে ১০ জন। জন্মনিয়ন্ত্রণকে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের অধিকাংশই মনে করে গুনাহ বা পাপকাজ। তাই তারা কোনো ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করে না।
উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক ইউনিসেফ কর্মী জানান, রোহিঙ্গাদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের কোনো সংস্কৃতি নেই। ফলে ক্রমেই বাড়ছে জন্মহার। পাশাপাশি রয়েছে বাল্যবিবাহের প্রচলনও।
তার মতে, আশ্রয় নেওয়া হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী রয়েছে উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে- যাদের সন্তান সংখ্যা পাঁচেরও বেশি। এমনকি দশের বেশি সন্তানের মায়ের সংখ্যাও কম নয়। তিনি বলেন, আমার এখন আটটি সন্তান। এদের কারও বয়স ১২, ৯, ৮, ৬ ও ৪ বছর।
জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়টি রোহিঙ্গা নারীরা মানতেই চান না বলে জানালেন ক্যাম্পে কর্মরত একাধিক স্বাস্থ্যকর্মী।
স্বাস্থ্যকর্মী ফরিদা আকতার বলেন, রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের মতে, পরিবার পরিকল্পনা করলে গুনাহ হবে। তাদের ঘরে ৮ থেকে ১০টি বাচ্চা রয়েছে।
ওই স্বাস্থ্যকর্মী আরও বলেন, তাদের জন্মনিয়ন্ত্রণের কথা বললে তারা ক্ষেপে যান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্বাস্থ্যকর্মী জানান, জন্মনিয়ন্ত্রণে কাজ করা হলেও নতুন বাচ্চা প্রসব হলে বা অন্তঃসত্ত্বা রোহিঙ্গা নারীরা বিভিন্ন এনজিও সংস্থা থেকে নানা সুবিধা পায়। ফলে তারা অধিক সুবিধা পাওয়ায় জন্মনিয়ন্ত্রণ করার কথা মাথায় আনে না।
কক্সবাজার পরিবার-পরিকল্পনা অধিদফতরের উপপরিচালক ডা. পিন্টু কান্তি ভট্টাচার্য বলেন, আমার কাছে ২২ হাজার ডেলিভারির হিসাব রয়েছে। ইউএনএইচআরের কাছে এসবের পুরো ডাটা রয়েছে। তার মতে, ২০১৭ সালের আগস্টের পর থেকে পরবর্তী ৩ বছর রোহিঙ্গা নারীদের গর্ভধারণের হার আগের মতোই ছিল।
সে হিসাবে রোহিঙ্গা নবজাতকসহ রোহিঙ্গা শিশুসন্তানের সংখ্যা লাখের কম নয়। জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ করার পর ২০২০-২১ সালে সচেতন হয়েছে অনেক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ। আমরা ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ ১৫ হাজার নারীকে ইনজেকশন দিয়েছি, ৩ লাখ ১২ হাজার নারীকে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি দিয়েছি এবং ৪৮ হাজার ৫শ’ জনকে কনডম দিয়েছি। এ ছাড়া তিন বছর মেয়াদি ও ১০ বছর মেয়াদি ইনজেকশন দিয়েছি আরও ৫ হাজার জনকে। তিনি আরও বলেন, আমরা প্রতি মাসের মিটিংয়ে এসব বিষয়ে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসককে অবগত করে থাকি।
কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসন কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, প্রতিটি দিনই এখন আতঙ্কের মধ্যে কাটে। রাতে ঘুম হয় না ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। পাহাড়-পর্বত-ফসলি জমি সব রোহিঙ্গাদের দখলে চলে গেছে। দিনের পর দিন তাদের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি তাদের অপরাধ সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মাত্রাও বাড়ছে। তাদের অপরাধ ও জন্মনিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভবিষ্যৎ ভালো হবে না।
অন্যদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্যাম্পে দায়িত্বরত কয়েকজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ক্যাম্প ইনচার্জের দাবি, রোহিঙ্গাদের জন্মনিয়ন্ত্রণে ক্যাম্পে নানা কার্যক্রম চলছে। এখন যে জন্মহার হচ্ছে আগামীতে তা অনেক কমে আসবে।
অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছুদ্দোজা বলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণে রোহিঙ্গা নারীদের বিষয়টি বোঝানোর জন্য পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর, স্বাস্থ্য বিভাগ ও এনজিওগুলো কাজ করছে। তার মতে, জন্মহার আছে তবে তা গত ৪ বছরে ২ লাখ হবে না। তা ছাড়া ক্যাম্পে কাজ করা সংস্থাগুলোকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে এ বিষয়ে।
উল্লেখ্য, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংস নির্যাতনে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে পালিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয় প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা (প্রথমদিকের হিসাব অনুযায়ী)। এরপর পুরনোসহ ক্যাম্প বাড়িয়ে ৩৪টি ক্যাম্প করা হয়। ইউএনএইচসিআরের মতে, বর্তমানে ক্যাম্পে তালিকাভুক্ত প্রায় ৯ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এ ছাড়া উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে প্রতিবছর নতুন জন্ম নেওয়া শিশুর হার ৪৩ হাজার।