বিনোদন

প্রথম গানের সম্মানী ২০ টাকা

বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী মো. খুরশীদ আলম। ছয় দশকের শিল্পীজীবনে বেতার, চলচ্চিত্র, টেলিভিশন, মঞ্চ- প্রতিটি মাধ্যমেই ছিল তার বিচরণ। এরই মধ্যে প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে তার। শিল্পীজীবনের এই দীর্ঘ পথপরিক্রমা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে তার সঙ্গে কথা হয় তার সঙ্গে

প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে ৫০ বছর পূর্ণ হলো। কেমন ছিল চলচ্চিত্রের দীর্ঘ সফরের অভিজ্ঞতা?

প্রতিটি কাজেই ভালো-মন্দ, হাসি-কান্না, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির নানা রকম অভিজ্ঞতা থাকে। শিল্পী হিসেবে আমাকে কষ্ট করতে হয়েছে, লড়াই করতে হয়েছে প্রতিষ্ঠার জন্য। তার পরও ভাগ্যবান অনেক মানুষকে পাশে পাওয়ায়, যাদের সহযোগিতা, প্রশ্রয় আর ভালোবাসা আমাকে এতটা পথ পাড়ি দেওয়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। নায়করাজ রাজ্জাক থেকে শুরু করে আজাদ রহমান, আবদুল জব্বার, সুবল দাশ, সত্য সাহা, খন্দকার নুরুল আলম, ডা. আবু হায়দার সাইদুর রহমান, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, খান আতাউর রহমান, মনিরুজ্জামান মনির, মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান, শেখ আবুল ফজল, খোন্দকার ফারুক আহমেদ, আবু তাহেরসহ কত সঙ্গীত পরিচালক, গীতিকার, সুরকার, যন্ত্রসঙ্গীতশিল্পী, নির্মাতা, প্রযোজক, অভিনয়শিল্পীকে যে পাশে পেয়েছি, তার হিসাব মেলানো কঠিন। তাদের প্রত্যেকে আমাকে কোনো না কোনোভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এর পাশাপাশি ছিল অগণিত ভক্তের ভালোবাসা, যা আমাকে এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার শক্তি জুগিয়েছে। তাই পেছন ফিরে তাকালে এই শিল্পীজীবনকে অপূর্ণ মনে হয় না।

চলচ্চিত্রে গান গেয়ে শিল্পীপ্রতিষ্ঠা, জনপ্রিয়তা সব কিছুই পেয়েছেন। তারপরও এই অঙ্গন থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণ কী?

যখন নিয়মিত প্লেব্যাক করতাম, তখনকার অনেক নির্মাতা এ অঙ্গন থেকে এসেছেন, যারা আমাকে নিয়ে নির্ভয়ে কাজ করতেন। মনে করতেন, আমি গান করলেই সেই গান ও ছবি জনপ্রিয় হবে। এমনও হয়েছে, কোনো কোনো ছবির সর্বাধিক গান আমাকে দিয়ে গাওয়ানো হয়েছে। শুধু নায়ক নয়, পার্শ্বচরিত্র এবং খলনায়কের ঠোঁটেও আমার গান ব্যবহার করা হয়েছে। ‘লালু ভুলু’ ছবির কথাই বলি। এ ছবির সাতটি গানই আমাকে দিয়ে গাওয়ানো হয়েছিল। লালু এবং ভুলু দু’জনের কণ্ঠেই আমি গেয়েছি। এমন উদাহরণ আরও অনেক আছে। গুনে গুনে এ পর্যন্ত ৪৫০টি ছবিতে প্লেব্যাক করেছি। যে কোনো শিল্পীর জন্য এ সংখ্যা অনেক বড়। মানছি, প্লেব্যাকের এ ছবির সংখ্যা আরও বড় হতে পারত, কিন্তু হয়নি। এর কারণ পুরনোরা তাদের জায়গা ছেড়ে চলে গেছেন। তাদের জায়গা যারা দখল করেছেন, তাদের অনেকে নতুন এবং নিজ পছন্দের শিল্পীদের নিয়ে কাজ করেছেন। এ জন্য আমাকেও নতুনদের জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে হয়েছে। তবে যারা আমাকে নিয়ে কাজ করতে চেয়েছেন, তাদের কাউকে নিরাশ করিনি।

শিল্পীজীবন শুরু রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে; কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত ছেড়ে আধুনিক গানের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন কী মনে করে?

কিছুটা চাপে পড়েই রবীন্দ্রসঙ্গীত ছেড়ে আধুনিক গানে দিকে ঝুঁকে পড়েছিলাম। ষাটের দশকের শুরুতে রবীন্দ্রসঙ্গীতে হাতেখড়ি। ১৯৬৫ সালে আইয়ুব খান রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করার আগ পর্যন্ত বেতারে নিয়মিত গান গেয়েছি। রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর আর গাওয়া হয়নি। কিন্তু গান না করে কি থাকা যায়? সঙ্গীত যার শোণিত ধারায় বহমান, সে জানে এটা কত কঠিন কাজ, যেজন্য আধুনিক গানের দিকে ঝুঁকে পড়েছি। সে সময় আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন খোন্দকার ফারুক আহমেদ। সেটা ১৯৬৬ সালের কথা। তার কাছে দু’দিনে সাতটি আধুনিক গান শিখে বেতারে অডিশন দিয়েছিলাম। বিচারক ছিলেন সমর দাস, আবদুল আহাদ ও ফেরদৌসী রহমান। আমার গান শুনে সমরদা বলেছিলেন, ‘তোমার কণ্ঠ ও গায়কি আমাদের পছন্দ হয়েছে। এও বুঝেছি, তুমি নিজের মতো নয়, অন্য এক শিল্পীকে অনুকরণ করে গাও।’ আমিও স্বীকার করেছিলাম, তার ধারণা মিথ্যা নয়। তখন সমরদা বলেছিলেন, ‘কারও মতো গাওয়ার চেষ্টা করলে তুমি কোনো দিনও ভালো শিল্পী হতে পারবে না। সবাই বলবে, খুরশীদ আলম অমুক শিল্পীর মতো গান গায়।’ এরপর জানতে চেয়েছিলেন আমি কোথায় থাকি। আমার ঠিকানা শুনে বলেছিলেন, ‘আমি লক্ষ্মীবাজারে থাকি। সকাল ৭টার মধ্যে চলে আসবে। আমি তোমার অনুকরণের ছাপ মুছে দেওয়ার চেষ্টা করব।’ আমি সে সুযোগ হাতছাড়া করিনি। প্রতিদিন সকাল ৭টায় চলে যেতাম তার বাসায়। তার কাছে শিখে নিজের মতো গাওয়ার চেষ্টা করতাম।

বেতারে আধুনিক গান গাওয়া শুরু করেছিলেন কবে?

সমর দাসের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজের মতো করে গাওয়া শুরুর এক বছর পর। ১৯৬৭ সালে আজাদ রহমানের সুরে ‘চঞ্চল দু’ নয়নে বল না’ গানটি ছিল প্রথম বেতারের জন্য রেকর্ড করা। সেদিনই তার সুরে ‘তোমার দু’হাত ছুঁয়ে’ গানটি রেকর্ড করি। একই দিনে দুটি গান রেকর্ড করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার। প্রথম গানের সন্মানী ২০ টাকা ছিল। একই সন্মানীতে দ্বিতীয় গানে কণ্ঠ দেওয়া। সেই শুরু। এরপর নিয়মিত আধুনিক গান করেছি।

প্লেব্যাকের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে?

বেতারে আধুনিক গান গাওয়া শুরু করার দু’বছরের মাথায় প্লেব্যাকের সুযোগ পাই। বেতারের মতো চলচ্চিত্রেও প্রথম গানের সুরকার ছিলেন আজাদ রহমান। গেয়েছিলাম ‘আগন্তুক’ ছবিতে। তবে একটা কথা না বললেই নয়, সিনেমার গান তৈরি হয় গল্প, চরিত্র ও ঘটনার ওপর ভিত্তি করে। তাই গাওয়া সহজ নয়। কীভাবে তা রপ্ত করতে হয়। কীভাবে চরিত্রের অভিব্যক্তির সঙ্গে গান করতে হয়, তা নায়করাজ রাজ্জাক নিজে অভিনয় করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। তার কাছে শিখেছি অনেক কিছু। এমনকি তার ঠোঁটে আমার অনেক গান শুনেছেন দর্শক। এটা ভাবলে নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে হয়।

চলচ্চিত্র, টিভি এবং অন্যান্য মাধ্যমে এখন যে তরুণ শিল্পীরা গাইছেন, তাদের কতটা সম্ভবনাময় বলে মনে হয়?

অনেকে ভালো গাইছে। কিন্তু কিছু শিল্পীর গায়কি শুনে মনে হয়েছে, তাদের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে, শুধু গানের ভালো অভিভাবক প্রয়োজন।

শিল্পীজীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে কখনও কি ভাবেন?

গান গেয়ে আমি গাড়ি, বাড়ির মালিক হইনি, কিন্তু অগণিত মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। গানের জন্য মানুষ আমাকে চেনে- এটা ভাবলে এক ধরনের আত্মতৃপ্তিতে মনটা ছেয়ে যায়। গানের মধ্য দিয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বেঁচে থাকতে পারা বড় সার্থকতা। তাই শিল্পী হিসেবে কখনও কোনো চাওয়া-পাওয়া হিসাব-নিকাশ কষিনি। তার পরও গানের জন্য রাষ্ট্রীয় পদকসহ অনেক সন্মাননা পেয়েছি। একজন শিল্পীর জন্য এর বেশি আর কিছু পাওয়ার থাকতে পারে না। আমারও নেই।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button