বাড়ল কন্টেনার হ্যান্ডলিং চার্জ
আমদানি রপ্তানি পণ্য হ্যান্ডলিং চার্জ বেড়ে গেছে। চট্টগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বেসরকারি আইসিডিগুলোর সংগঠন বিকডা গতকাল থেকে সব ধরনের সেবার চার্জ বাড়িয়ে দিয়েছে। শুরুতে ২২ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত চার্জ বাড়িয়ে দেয়া হলেও পরবর্তীতে ১২ শতাংশ চার্জ বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তবে বন্দর ব্যবহারকারী বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে চার্জ বাড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে।
তারা বলছে, চার্জ বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছে। এরমাঝে কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই চার্জ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। গতকাল সকাল থেকে বর্ধিত চার্জ নেয়াকে কেন্দ্র করে নানা সংকট তৈরি হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেনার আনা নেয়াসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়েছে।
পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও বর্ধিত চার্জ নিয়ে ‘অশান্তি’ বিরাজ করছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ নতুন করে বৈঠক করে অফ ডক চার্জ নিয়ে সৃষ্ট সংকট সুরাহার উদ্যোগ নেবেন বলে সূত্র জানিয়েছে। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমকে সহজ করতে বেসরকারি আইসিডি স্থাপন করা হয়েছে। চট্টগ্রামে মোট ১৯টি বেসরকারি আইসিডি রয়েছে। এসব আইসিডি থেকে গার্মেন্টস রপ্তানির শতভাগ পণ্য হ্যান্ডলিং করার পাশাপাশি ৩৭ ধরনের আমদানি পণ্য হ্যান্ডলিং করা হয়। বেসরকারি আইসিডিগুলোতে নির্দিষ্ট পরিমানে চার্জ আদায় করে এসব পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে সব ধরনের সেবা প্রদান করা হয়। এরমধ্যে বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে যাওয়া, পণ্য খালাস করা, কন্টেনারে বোঝাই করা, ডেলিভারী দেয়া থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সব ধরনের কার্যক্রম বেসরকারি আইসিডিগুলো থেকে করা হয়ে থাকে।
গত ১ আগস্ট থেকে বেসরকারি আইসিডিগুলোতে সব ধরনের সেবার চার্জ বাড়িয়ে দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। বেসরকারি আইসিডি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড কন্টেনার ডিপো এসোসিয়েশনের (বিকডা) এই চার্জ বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। পরবর্তীতে সেবাগ্রহীতাদের আপত্তি এবং বন্দরে অচলাবস্থা সৃষ্টির আশংকায় বিকডা চার্জ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত স্থগিত করে। সেবাগ্রহীতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ট্যারিফ কমিটির সিদ্ধান্ত ছাড়াই অযৌক্তিকভাবে চার্জ বাড়াচ্ছেন অফডক মালিকরা।
এতে ব্যবসা বাণিজ্যের খরচ আরো বেড়ে যাবে। তাই ট্যারিফ কমিটির সিদ্ধান্তের বাইরে চার্জ বৃদ্ধি করা যাবে না। তবে অফডক মালিকদের দাবি, অফডকের পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এই মুহূর্তে চার্জ বাড়ানোর বিকল্প নেই। ওই সময় বিকডা ২২ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত চার্জ বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়। যাতে প্রতিটি খাতেই ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে বন্দর ব্যবহারকারী এবং বিকডার মাঝে সৃষ্ট তিক্ততার জের ধরে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ১৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। ওই কমিটির আলাপ আলোচনা করে ট্যারিফ নির্ধারণ করা হবে বলেও উল্লেখ করা হয়। কমিটিতে বিকডা ছাড়াও শিপিং এজেন্ট, বাফা, বিজিএমইএ, বিকেএমএর প্রতিনিধি রয়েছেন। এই কমিটি ইতোমধ্যে কয়েকটা মিটিং করেছে।
কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে পারেনি। কমিটি সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত না করলেও বিকডা নতুন করে আবারো চার্জ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। গতকাল সকাল থেকে ২২ থেকে ২৫ শতাংশ বর্ধিত চার্জ আদায় করতে থাকে। এতে রপ্তানি পণ্যবাহী ২০ ফুট কন্টেনারের প্যাকেজ চার্জ ৩ হাজার ৬০০ থেকে বাড়িয়ে ৪ হাজার ৫০০ টাকা, ৪০ ফুট কন্টেনারের প্যাকেজ চার্জ ৪ হাজার ৮০০ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৬ হাজার টাকা, প্রতিদিনের গ্রাউন্ড রেন্ট চার্জ ২০ ফুট কন্টেনারে ১০০ এর স্থলে ১২৫ টাকা, ৪০ ফুট কন্টেনারে ২০০ এর স্থলে ২৫০ টাকা, ল্যান্ডিং চার্জ প্রতি টন ১৮০ থেকে বাড়িয়ে ২২৫ টাকা, কন্টেনার ওঠানামা চার্জ (লিফট অন বা লিফট অফ) কন্টেনার প্রতি ৩০০ থেকে বাড়িয়ে ৩৭৫ টাকা, ডকুমেন্টেশন চার্জ ২৪০ টাকার স্থলে ৩০০ টাকা, কন্টেনার পরিবহন চার্জ ২০ ফুটের ক্ষেত্রে ১ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ২৫০ এবং ৪০ ফুট কন্টেইনারের ক্ষেত্রে ২ হাজার থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার ৫০০ টাকা, কার্গো রিসিভিং চার্জ প্রতি কার্টন ৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ৫০ পয়সা করা হয়।
বর্ধিত এই চার্জ আদায়কে কেন্দ্র করে অচলাবস্থা তৈরি হয়। বন্দর ব্যবহারকারী বিভিন্ন সংগঠন তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে। এক পর্যায়ে বেসরকারি আইসিডিগুলো থেকে পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে পড়ে।
সৃষ্ট অচলাবস্থায় বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল জুলফিকার আজিজ টেলিফোন করে বিকডা নেতাদের চার্জ নিয়ে সৃষ্ট অচলাবস্থা নিরসনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি বিষয়টি নিয়ে বৈঠক করে সকল পক্ষের আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহার করবেন বলে আশ্বস্ত করেন। বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান দুয়েক দিনের মধ্যে জরুরি বৈঠক করার কথাও বলেন।
বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের টেলিফোনের প্রেক্ষিতে বিকডার পক্ষ থেকে চার্জ ২২ থেকে ২৫ শতাংশের পরিবর্তে ১২ শতাংশ বৃদ্ধি করার ঘোষণা দেয়া হয়। গতকাল সন্ধ্যা থেকে উক্ত ১২ শতাংশ বর্ধিত চার্জ আদায় করা হচ্ছে বলেও বিকডার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এতে করে গতকাল বিকেল থেকে রপ্তানি পণ্যবাহী ২০ ফুট কন্টেনারের প্যাকেজ চার্জ ৩ হাজার ৬০০ থেকে বাড়িয়ে ৪ হাজার ১০০ টাকা করা হয়েছে। একইভাবে ৪০ ফুট কন্টেনারের প্যাকেজ চার্জ ৪ হাজার ৮০০ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫ হাজার ৪শ’ টাকা। প্রতিদিনের গ্রাউন্ড রেন্ট চার্জ ২০ ফুট কন্টেনারে ১০০ এর স্থলে ১১২ টাকা, ৪০ ফুট কন্টেনারে ২০০ এর স্থলে ২২৪ টাকা পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে। ল্যান্ডিং চার্জ প্রতি টন ১৮০ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ২০২ টাকা। কন্টেনার ওঠানামা চার্জ (লিফট অন বা লিফট অফ) কন্টেনারপ্রতি ৩০০ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩৩৬ টাকা। ডকুমেন্টেশন চার্জ ২৪০ টাকার স্থলে করা হয়েছে ২৭০ টাকা। কন্টেনার পরিবহন চার্জ ২০ ফুটের ক্ষেত্রে ১ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ১২০ এবং ৪০ ফুট কন্টেইনারের ক্ষেত্রে ২ হাজার থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার ২৪০ টাকা পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে। কার্গো রিসিভিং চার্জ প্রতি কার্টন ৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ টাকা ৪০ পয়সা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিকডা সেক্রেটারি মোহাম্মদ রহুল আমিন শিকদার। তিনি বলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে খরচ এত বেড়ে গেছে যে চার্জ বৃদ্ধি না করে অফডক পরিচালনা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। তাই খুবই সীমিত পরিসরে চার্জ বাড়ানো হয়েছে। ১২ শতাংশ চার্জ বৃদ্ধির ব্যাপারটি সকল পক্ষের নিকট সহনীয় থাকবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
বিকডার একজন নেতা বলেন, অফডক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। বিকডার সেবাখাতের চার্জ সরকার ঠিক করে দেবে এটি কোনোভাবে কাম্য হতে পারে না। বিকডার সেবাগ্রহীতারা সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবিধা নিয়ে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে ট্যারিফের বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছেন। অফডক নিয়ে ট্যারিফ কমিটির বিষয়ে আমরা শুরু থেকে আপত্তি জানিয়ে আসছিলাম। কারণ শিপিং এজেন্ট, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স এবং সিএন্ডএফকে কখনো বলা হয়নি তারা কি পরিমাণ চার্জ নিতে পারবে। তাহলে বেসরকারি অফডকের ক্ষেত্রে কেন এটি হবে? এমনকি যেসব ট্রাক-কাভার্ডভ্যান এসব অফডক থেকে কন্টেনার পরিবহন করে তারা কত চার্জ নেবে সেটিও তাদের এখতিয়ার। বর্তমানে ব্যবসার আনুষঙ্গিক ব্যয় বাড়ার কারণে চার্জ বাড়াতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বলেন, বেসরকারি কন্টেনার ডিপোতে চার্জ বৃদ্ধির বিষয়টি একটি চলমান প্রক্রিয়া। আমরা চাই বিদ্যমান আইসিডি নীতিমালা মেনেই চার্জ বৃদ্ধি করা হোক। ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে গঠিত ট্যারিফ কমিটির অনেকগুলো সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে কন্টেনার ডিপোর স্টেকহোল্ডাররা তাদের মতামত দিয়েছেন। এখন চার্জ বৃদ্ধির বিষয়টি শেষ পর্যায়ে আছে। ট্যারিফ কমিটি শিগগিরই মন্ত্রণালয়ে চার্জ বৃদ্ধির বিষয়টি সুপারিশ আকারে পাঠাবে। আমরা চাই, সবার স্বার্থ দেখেই যেন কন্টেনার ডিপোতে চার্জ বৃদ্ধি করা হয়।
পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি এম এ সালাম বলেন, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে গঠিত ট্যারিফ কমিটি অফডকে চার্জ বাড়ানোর বিষয়ে পাঁচটি মিটিং করেছে। আরো মিটিং করার কথা রয়েছে। অথচ বিকডা স্টেকহোল্ডারদের সাথে আলোচনা ছাড়াই চার্জ বৃদ্ধির যে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে তাতে আমরা বিস্মিত। এম এ সালাম বলেন, বিকডা ব্যবসা করছে। আমরাও ব্যবসা করছি। তারা চার্জ বাড়ানোর প্রস্তাব করতে পারে। সবই ঠিক আছে। তবে আলাপ আলোচনা করে চার্জ নির্ধারণ করা হলে সকলের জন্য সুবিধা হতো। আমরা যেখানে কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস কমানোর জন্য যুদ্ধ করছি সেখানে চার্জ বৃদ্ধির বিষয়টি আমাদের চরমভাবে হতাশ করছে। বিকডার এই সিদ্ধান্ত পোশাক শিল্প খাতেহ নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
বিকডার সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন শিকদার বলেন, চার্জ বাড়ানোর কথা ছিল গত ১ এপ্রিল। পরবর্তীতে দফায় দফায় চেষ্টা করা হলেও নানা অজুহাতে চার্জ বাড়ানো ঠেকিয়ে দেয়া হয়েছে। এভাবে অফডক চালানো সম্ভব না হওয়া বিকডা খুবই সামান্য পরিমানে চার্জ বৃদ্ধি করেছে বলেও রহুল আমিন শিকদার উল্লেখ করেন।