মহিষের মাংস আমদানি বাড়ছে অনুমতি ছাড়াই
হাজার হাজার মণ পচা মাংস ধরা পড়ার পরও থামেনি মাংস আমদানি। কয়েক মাসের ব্যবধানে মহিষের হিমায়িত মাংস, যকৃত ও ফুসফুসের আমদানি বেড়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই প্রতি মাসে গড়ে পাঁচ-ছয় লাখ কেজি মহিষের মাংস প্রবেশ করছে। কোনো ধরনের উন্নত পরীক্ষা ছাড়াই এসব মাংস প্রবেশ করছে। আবার অভিযোগ রয়েছে এসব মাংস গরুর মাংস হিসেবেই বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এতে ভোক্তাদের প্রতারিত হওয়ার সুযোগ বাড়ছে। এতে দেশের পশুসম্পদ খাত বিশেষ করে খামারিদের উদ্বেগ বাড়ছে।
জানা গেছে, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ২০০৫ সালের একটি আইন রয়েছে, যা ‘বাংলাদেশ পশু ও পশুজাত পণ্য সঙ্গনিরোধ আইন, ২০০৫’ নামে পরিচিত। এই আইনের আওতায় কেউ যদি পশু ও পশুজাত পণ্য আমদানি করতে চান, তার অন্তত ১৫ দিন আগে এ সম্পর্কে নিয়োজিত কর্মকর্তাকে নির্ধারিত পদ্ধতিতে জানাতে হবে। সব বিষয় আমলে নিয়ে যদি এই প্রক্রিয়ায় অনুমতি দেওয়া হয় তবেই একজন আমদানিকারক আমদানি করতে পারবেন। অথচ কোনো অনুমতি ছাড়াই দেশে প্রতিবছর লাখ লাখ কেজি মহিষের মাংস আমদানি হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে হিমায়িত মহিষের মাংস ও ওফালস (যকৃত, ফুসফুসসহ অনান্য) আমদানি হয়েছে তিন লাখ ৩৬ হাজার কেজি। মে মাসে ছিল তিন লাখ ৭৪ হাজার কেজি, জুন মাসে ছয় লাখ তিন হাজার কেজি, জুলাই মাসে পাঁচ লাখ ৪৭ হাজার কেজি ও আগস্ট মাসে তিন লাখ ৯১ হাজার কেজি। গত পাঁচ মাসেই মহিষের মাংস আমদানি হয়েছে প্রায় ২২ লাখ ৫২ হাজার কেজি। আর এসব মাংসের প্রধান উৎস ভারত।
অথচ এ বছরের শুরুতেই র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে হাজার হাজার কেজি হিমায়িত পচা মাংস ধরা পড়েছে কয়েকটি হিমাগারে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো বলেছিল, দেশে মাংস আমদানির কোনো সুযোগই নেই। কেউ আমদানি করলে তা হতে হবে বিশেষভাবে অনুমতিসাপেক্ষে।
এ প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী ওয়াসী উদ্দিন বলেন, কোনো প্রকার হিমায়িত মাংস কিংবা প্রক্রিয়াজাত মাংস আমদানি অনুমোদন না দেওয়ার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে। আমদানি আদেশ সংশোধন করার জন্যও বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে আমদানি করা মাংসে রোগ-ব্যাধি আছে কি না সেগুলো পরীক্ষা করার মতো তেমন যন্ত্র বা পরীক্ষাগার নেই। কিছু ল্যাব আছে চট্টগ্রামে কিন্তু সেটা পর্যাপ্ত নয়। আমাদের দেশের খামারিরা এখন চাহিদার শতভাগ পূরণে সক্ষম। তাই আমদানি বন্ধ করতে সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
বিশেষজ্ঞ ও খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাহিদার চেয়ে বেশি গরু উৎপাদন হচ্ছে দেশে। বিদেশ থেকে মাংস আনা হলে গ্রামের সাধারণ কৃষকসহ প্রান্তিক খামারিরা তাঁদের উৎপাদিত গরুর উপযুক্ত দাম থেকে বঞ্চিত হবেন। এতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ধস নামার পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর হবে। তাতে দেশের দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানি খাত চামড়াশিল্পে কাঁচামালের সংকট দেখা দেবে। পাশাপাশি সংকটে পড়বে দেশের চামড়া শিল্প ও দুগ্ধ উৎপাদন শিল্প।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাহ এমরান বলেন, দুগ্ধ শিল্প ও মাংস শিল্প একই সূত্রে গাথা। পশু পালনের মাধ্যমে দেশের প্রায় দেড় কোটির বেশি পরিবার সরাসরি যুক্ত রয়েছে। আমদানিনির্ভরতা বাড়লে তরুণরা বেকার হয়ে পড়বেন। পাশাপাশি দুগ্ধশিল্পও আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে। দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি নাজুক অবস্থায় পড়তে বাধ্য হবে।
অভিযোগ রয়েছে, এসব আমদানি করা মাংসের বড় ক্রেতা হলো বিভিন্ন সুপার শপ ও হোটেল-রেস্টুরেন্ট। যারা এসব মহিষের মাংস গরুর মাংস হিসেবে বিক্রি করে এবং ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) মহাব্যবস্থাপক ও প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞ ড. শরীফ আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘হিমায়িত মাংস আমদানিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য বাংলাদেশে উন্নত মানের পরীক্ষাগার নেই। ফলে পরীক্ষা ছাড়াই মাংস ঢুকছে দেশের বাজারে, যা ভোক্তার স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে।’ তিনি বলেন, ‘মাংসের চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে দেশীয় উৎপাদনের মাধ্যমে। আমদানি বন্ধ করতে না পারলে দেশের প্রায় চার কোটি মানুষ ক্ষতির শিকার হবে।