সম্পাদকীয়

সাধারন পেনশনধারীরা নিম্নমধ্যবিত্তের চেয়েও অসহায়!

নব্বই দশকে তদানিন্তন আমলাদের পরামর্শে অবসরভোগীদের জন্য সরকার এক নতুন বিধি চালু করে। অবসরগমনের প্রাক্কালে সরকারী কর্মচারীরা ইচ্ছে করলে পেনশন বাবদ প্রাপ্য সাকুল্য অর্থ একবারেই উঠিয়ে নিতে পারবেন। এই সুযোগ কাজে লাগান প্রায় সকল পদস্থ সরকারী কর্মকর্তারা; বিশেষ করে সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দ। তারা একবারেই পেনশনের সাকুল্য অর্থ উঠিয়ে সরকারের সংগে দেনা-পাওনার আর্থিক সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলেন। প্রাপ্ত পেনশনের টাকা তারা বিভিন্ন ব্যবসা বানিজ্যে বিনিয়োগ করেন, কেউ কেউ আবার মেয়াদী সঞ্চয়পত্রে জমা রেখে মাসিক বা ত্রয়মাসিক লভ্যাংশ তুলে দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহ করেন। কেউ কেউ আবার শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে অঢেল অর্থের মালিক হন। গত সরকারের সময় এই সচিবেরা অবসরপ্রাপ্ত কেবিনেট সচিব আলী ইমাম মজুমদারের নেতৃত্বে ‘তারা প্রাপ্ত পেনশনের টাকা খেয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন’ ধুয়া তুলে আর এক অবসরপ্রাপ্ত সচিব তদানিন্তন অর্থমন্ত্রী আবুল মা’ল আব্দুল মুহিতের সহযোগিতায় পুনরায় পেনশন পাওয়ার জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করেন। সরকার তাদের এই দাবী করে সবাইকে পুনরায় পেনশন মঞ্জুর করেন। সরকারী অর্থের এতবড় অপচয় জনগন বুঝতে পারেনি অথবা চুপ করে আছে এই ভেবে যে ‘হতভাগ্য নিঃস্ব অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তারা বাকী জীবন খেয়ে পড়ে সুখে সাচ্ছন্দে বেঁচে থাকুক।’ অর্থমন্ত্রী মুহিত নিজেও ১০০% পেনশন উত্তোলনকারী ছিলেন বিধায় এই সুযোগের উপকারভোগী হিসেবে তাঁর প্রচেষ্টা ছিল লক্ষ্যনীয়। কিন্তু মুহিত সাহেব একবারও চিন্তা করলেন না শত সহস্র সরকারী কর্মকর্তা – কর্মচারী যারা একবারে পেনশনের সাকুল্য অর্থ না তুলে মাসে মাসে পেনশন বই হাতে নিয়ে ব্যাংকের দোরগোড়ায় পেনশনের কটা টাকা উত্তোলনের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তাদের কথা। সে সময় বেতনের স্কেল এত কম ছিল যে মাসিক পেনশন ছিল নামমাত্র।

আমি ক্যাডারভুক্ত একজন প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তা। ‘৯১ সালে অবসর নিয়েছি।আমার বর্তমান মাসিক পেনশন মাত্র ১১,৯০০/০০ টাকা। নানাবিধ অসুখের রোগী হওয়ায় মাসে ওষুধ লাগে ৩০/৪০ হাজার টাকার; ডাক্তারের ফিস তো আছেই। সারা মাস খাব কি! অন্যান্য আনুসাংগিক ব্যায়ের কথা নাই বা বললাম। আমার মতই অবস্থা শতসহস্র অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ কর্মকর্তা কর্মচারীদের। আমরাও যৌবনটা দিয়েছিলাম দেশ সেবায়। আমাদের দুরবস্থা আলী ইমাম মজুমদার বা মুহিত সাহেবরা স্বার্থপরের মত হিসেবে আনেন নি, যা অত্যন্ত দুঃখজনক! রাষ্ট্রের শতসহস্র কোটি টাকা এই মুহিত সাহেবের সময় লোপাট হয়েছে, যার কোন কৈফিয়ত তাঁকে দিতে হয়নি। তবে তিনি দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেও তার সময়ের আর্থিক দুর্নীতির বিচার হবে। তিনি দুর্নীতিবাজ তা বলছি না। কিন্তু তাঁর অনেক হঠকারি সিদ্ধান্তে আর্থিক লুটতরাজ বিশেষ করে ব্যাংক লুটপাট বেড়ে গিয়েছিল, যার কোন শাস্তি হয়নি।

যাক,ধান ভানতে শীবের গীত গাইলাম। প্রসংগক্রমে মুহিত সাহেবের কথা এসে গেছে। আবার বলি, উনি একজন সৎ অফিসার ছিলেন। কিন্তু অন্যান্য পেনশনভোগীদের ব্যপারে ন্যায় বিচার করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
শুধু আমার আর্থিক অবস্থা যদি বর্ননা করি তাহলে পাঠক অবাক হবেন এই ভেবে যে আমি বেঁচে আছি কিভাবে! দীর্ঘদিন প্রথম শ্রেনীর চাকুরি করে অবসর নেবার প্রাক্কালে আমার নিজ জেলা বগুড়া শহরে বা ঢাকা মেট্রোপলিটন শহরে একটা বাড়ী নেই বা বাড়ী করার একখন্ড জমিও নেই। বগুড়ায় বাবার বাড়ীতে বসবাস করি। অবসর গ্রহনের পর পেটের তাগিদে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির দুটি প্রকল্পে কয়েক বছর কনসালটেন্সি করে জীবিকা নির্বাহ করেছি। এখন বয়সজাত কারনে কোন কাজ করতে পারিনা। সরকারী চাকুরীজীবনে সততাই ছিল আমার মূলমন্ত্র। শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে চাকুরির সুবাদে অনেক ছেলেমেয়েকে স্কলারশিপ দিয়ে বিদেশে পাঠালেও নিজের একমাত্র ছেলে(ঢাকা কলেজের মেধাবী ছাত্র)কে কাউকে ডিংগিয়ে বিদেশে পাঠাইনি। সচিব মহোদয়ের পি এস হিসেবে স্কলারশীপ আমিই দেখতাম। চাকুরী জীবনের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্রশংসাপত্রের স্তুপ দেখে আমার কন্যা সুনামগঞ্জ গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক নাসিমা রহমান গর্ব করে বলে, ‘তোমার সততাই আমাদের অহংকার’।

কিন্তু জীবনের শেষপ্রান্তে দেখি টাকার বড় প্রয়োজন। অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান সব ক্ষেত্রেই টাকা লাগে। আমার অংশে পাওয়া বাবার জমি বিক্রী করে, বেস্ট অফিসার হিসেবে পুরষ্কার পাওয়া .২২ বোর রাইফেল বিক্রী করে, ভাইবোনদের আর্থিক সহায়তায় মরনঘাতী কিডনী রোগের চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছি। এ অবস্থা শুধু আমার একার নয়। বর্তমান সরকারের পূর্বে যারা অবসর নিয়েছেন প্রায় সকলের একই অবস্থা। এখন একজন ডেপুটি সেক্রেটারীর মিনিমাম মাসিক বেতন ৫০০০০/০০টাকা। গাড়ী ক্রয়ের লোন সুদবিহীন ৫০০০০০০/০০ টাকা, গাড়ীর রক্ষনাবেক্ষন বাবদ মাসিক ৫০০০০/০০ টাকা। এছাড়াও রয়েছে বাড়ী বা ফ্লাট কেনার বিনাসুদে লোন সুবিধা। শেখ হাসিনার সদাশয় সরকার কর্মকর্তাদের এত সুযোগ সুবিধা দিয়ে প্রকৃতভাবে মূল্যায়ন করেছেন, যা পূর্বে কোন সরকার করেনি। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে বর্তমান কর্মকর্তাদের এভাবে মুল্যায়ন করায় আমরা গর্বিত।

আমরা লক্ষ লক্ষ পেনশনভোগীরা বিশেষ করে যারা ২০০৮ এর পূর্বে অবসরে গেছি তাদের অবস্থা এতটাই সঙ্গীন যে আমাদের জীবনযাত্রা নিম্ন মধ্যবিত্তের পর্যায়ে চলে গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আমরাও আপনার প্রাক্তন সরকারী কর্মী। আপনি আমাদেরও অভিভাবক। আপনি কখনই চাইবেন না জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় জনসেবায় কাটিয়ে এই জীবন সায়াহ্নে আমরা বিনা খাদ্যে, বিনা চিকিৎসায় দেহত্যাগ করি। মাসে প্রয়োজন কমপক্ষে ৫০০০০/০০ টাকা। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্রেড অনুযায়ী আপনার সদাশয় সরকার আমাদের পেনশন পুনঃনির্ধারন করে বেঁচে থাকার সুযোগ দিতে মর্জি হয়। উল্লেখ্য যে, আমাদের কোন লবিস্ট বা মুহিত সাহেবের মত মন্ত্রী নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনিই আমাদের একমাত্র ভরসা। মহান আল্লাহ আমাদের দেশসহ সারা পৃথিবীকে করনাভাইরাস-সহ যাবতীয় মহামারী থেকে রক্ষা করুন এবং আপনাকে দীর্ঘায়ু করুন, এই কামনায়–

মোঃ আনিসুর রহমান
একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা
কলাবাগান, ঢাকা।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Back to top button