সম্পাদকীয়

সর্বত্র নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হোক

বিশ্বের মহৎ কাজগুলোতে নারীরাও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। আমাদের দেশেও একই চিত্র লক্ষ করা গেছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে, ২১শে ফেব্রুয়ারি নারীরাই প্রথম পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে ১৪৪ ধারা অমান্য করে মিছিল করেছিল। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও রয়েছে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অংশগ্রহণ। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে নারীর গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ থাকা সত্ত্বেও সেগুলোর প্রচার এখনো আশানুরূপ নয়। নতুন প্রজন্মের কাছে নারীদের এই অসামান্য কীর্তিগাথা তুলে ধরার এখনই সময়।

বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসনে বঙ্গবন্ধুর অবদান ইতিহাস শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের সামাজিক স্বীকৃতি ও সম্মান প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু তাদের দিয়েছিলেন ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি। মুক্তিযুদ্ধ গবেষক শাহিনা বলেন, ‘এক বীরাঙ্গনা বঙ্গবন্ধুর কাছে এসে সমাজে তাদের অবর্ণনীয় দুর্দশার কথা জানালে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন তারা এখন থেকে বীরাঙ্গনা হিসাবে সম্মানীয় হবেন।’

প্রবাসীদের সংগঠিত করেছিলেন আশালতা সেন। ডা. ফৌজিয়া মোসলেম আগরতলায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চিকিৎসা ক্যাম্প পরিচালনা করেছেন। এ ছাড়া নাম না-জানা অনেক নারী দেশের বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট দল গঠন করে সাংগঠনিক কাজ করেছেন। থানা শহর বা গ্রামে যে নারী আরও কয়েকজন নারীকে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য, খবর, অস্ত্র পৌঁছে দিয়েছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের নাম জানা যায় না। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে নারী সংগঠক হিসাবে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাদের মধ্যে মতিয়া চৌধুরী, সাজেদা চৌধুরী, নূরজাহান মুরশিদ, মমতাজ বেগম প্রমুখের নাম অনেকেরই জানা।

কত নির্যাতন সহ্য করে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের মা-বোনেরা অবদান রেখেছেন, সেসব তথ্য নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আফসান চৌধুরী। তিনি লিখেছেন, শিক্ষিত নারীদের মতো গ্রামের সাধারণ নারীরাও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ছিলেন। বর্তমানে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতিসহ মুক্তিযোদ্ধাদের কষ্ট লাঘবের নিমিত্ত নানামুখী কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের ‘মুক্তিযুদ্ধে নারী’ নিবন্ধের শুরুতেই উল্লেখ করেছেন, ‘দেশজুড়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপিত হচ্ছে। ফিরে আসছে মুক্তিযুদ্ধের কথা। বাঙালির গৌরবময় ইতিহাস। এই ইতিহাসে নারীরা সঠিক জায়গায় মূল্যায়িত হয়নি।’ তবে তিনি এটাও উল্লেখ করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে ব্যাপক অনুসন্ধানের ফলে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা নারীদের নতুন নতুন তথ্য জানা যাচ্ছে।

বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক মাহফুজা হিলালী ‘মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান’ নিবন্ধে উল্লেখ করেন, মুক্তিযুদ্ধে আফসান চৌধুরীর রচিত ‘গ্রামের একাত্তরে’ নিবন্ধে গ্রামীণ নারীরা কিভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন, খাবার দিয়েছেন, অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছেন তার সরল বর্ণনা রয়েছে। তিনি উল্লেখ করেছেন, এই গ্রামীণ নারীরা এখনো রয়েছেন নিভৃতে। তাদের অবদানকে আলোয় না আনতে পারলে আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস অপূর্ণাঙ্গ থেকে যাবে।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করেছেন কিন্তু নারীদের বেদনা ও কষ্ট ছিল অনেক বেশি। বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের ‘মুক্তিযুদ্ধে নারী ও একজন যুদ্ধশিশুর অসমাপ্ত যুদ্ধ’ শিরোনামে নিবন্ধটি পাঠে দেখা যায় তিনিও মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানের অনেক না-জানা অধ্যায়ের জানান দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন ৯ মাসের দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শাহাদতবরণ করেছেন এবং সম্ভ্রম হারিয়েছেন দুই লাখ মা-বোন। মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী এই ৩০ লাখ শহিদের মধ্যে কতজন পুরুষ, আর কতজন নারী তার হিসাব কেউ রাখেনি। হয়তো এই হিসাবও রাখা হয়নি যে, কতজন নারী সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। তারামন বিবি, ক্যাপ্টেন সেতারা বেগম, কাঁকন বিবি, গীতা কর, শিরিন বানু প্রমুখ বিশিষ্ট নারী মুক্তিযোদ্ধার নাম হয়তো আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু যে অগণিত মা-বোন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তার হিসাব আমরা কি কখনো রেখেছি?

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ‘রাজাকার’ শব্দটি অত্যন্ত ঘৃণিত অর্থে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে কোনো নারী রাজাকার ছিল না এই তথ্যটি জেনে গর্বে বুক ভরে যায়।

বৈশ্বিক লিঙ্গ সমতা সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘বৈশ্বিক লিঙ্গ সমতা সূচক-২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্বের ১৫৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৫০তম। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ রয়েছে, বাংলাদেশ হল বিশ্বের একমাত্র দেশ, যেখানে গত ৫০ বছরে শীর্ষস্থানে পুরুষদের তুলনায় নারীরা দীর্ঘমেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন। নারীর ক্ষমতায়নে নিঃসন্দেহে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত। কিন্তু এখনো দেশের মন্ত্রিপরিষদে মাত্র আট শতাংশ নারী প্রতিনিধি রয়েছেন আর সংসদে রয়েছেন ২০ শতাংশ। এ পরিপ্রেক্ষিতে নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, নারীর ক্ষমতায়নে এখনো আমাদের অনেক অপূর্ণতা রয়েছে।

এখনো নারীকে ঘরে-বাইরে প্রতিনিয়ত সহিংসতার শিকার হতে হয়। তাই ধর্ষণের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন করা আবশ্যক। ধর্ষক যেই হোক না কেন তাকে আইনের আওতায় এনে দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে। পাশাপাশি এক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ কর্তৃক অভিযোগ গ্রহণ সম্পর্কিত হটলাইন সার্ভিসগুলো নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা ও আইনগত সেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ট্রমাটাইজড নারীদের সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজন ঢ়ংুপযড়-ংড়পরধষ কাউন্সেলিং এবং ক্ষেত্রবিশেষে আর্থিক সহায়তা ও সামাজিক সম্মান। একইসঙ্গে প্রয়োজন আমাদের মানসিকতা এবং চিন্তাধারার পরিবর্তন। এ বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমও অব্যাহত রাখা দরকার। দুঃখজনক হল, সম্প্রতি ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি বিষয়ক আইন প্রণয়নের পরও তা থেমে থাকেনি।

একজন নারীর সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। নারী-পুরুষ উভয়ই মানুষ-যেদিন আমরা এই সত্য যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব, কার্যত সেদিনই নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা এবং যৌন নিপীড়ন কমে আসবে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট সবার বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। আর কোনো মা-বোনকে যাতে যৌন সহিংসতা ও পারিবারিক নিপীড়নের শিকার হতে না হয়; এটা নিশ্চিত করতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

নাছিমা বেগম : চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button