স্বাস্থ্য

‘একটপিক প্রেগন্যান্সি’ এক বিপদজনক গর্ভধারণের নাম

গর্ভধারণ একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলনে যে জাইগোট তৈরি হয় তা জরায়ুতে স্থাপিত হয়। এটি হচ্ছে স্বাভাবিক গর্ভধারণ। কিন্তু কোনো কারণে যদি জাইগোটের এই প্রতিস্থাপন জরায়ুতে না হয়ে অন্য কোথাও হয় তবে তাকে বলে ‘একটপিক প্রেগন্যান্সি’। একটপিক প্রেগন্যান্সিকে টিউবাল প্রেগন্যান্সিও বলা হয়। এটি একটি গর্ভধারণ সংক্রান্ত জটিলতা।

আশার কথা হচ্ছে এই ঘটনা অনেকটা বিরল, সাধারণত ৫০টি প্রেগন্যান্সির মাঝে ১টি প্রেগন্যান্সি পাওয়া যায় এই সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে। বলা যায়, একটপিক প্রেগন্যান্সি বিরল ঘটনা এবং একই সঙ্গে বিপদজনক। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে ঘটে যেতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা। একটপিক প্রেগন্যান্সি বুঝতে হলে আগে আলোচনা করা যাক স্বাভাবিক প্রেগন্যান্সি নিয়ে।

নালীর মতো যে অংশটি ফ্লাজেলা দিয়ে ওভারির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সেটি হলো ফেলোপিয়ান টিউব, এই ওভারি বা ডিম্বাশয় থেকে প্রতি মাসে একটি বা ক্ষেত্রবিশেষে একাধিক ডিম ফেলোপিয়ান টিউবে আসে। এবং এই টিউবে ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করে। এর মাঝে যদি সেটি কোনো শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত না হয় তাহলে সেটি নষ্ট হয়ে যায়।

ফেলোপিয়ান টিউবে থাকাকালীন সময়ে যদি ডিম্বাণু কোনোভাবে শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয়ে যায় তখন এটি ধীরে ধীরে ৬ থেকে ১০ দিনের মাঝে জরায়ুর মাঝে চলে আসে। অতঃপর জরায়ুতে প্রতিস্থাপিত হয়। যাকে বলে গর্ভধারণ।

এখন কোনো জটিলতাবশত যদি এমন হয় যে, ডিম্বাণু এবং শুক্রাণু মিলিত হলো, কিন্তু কোনো কারণে তা জরায়ুতে এসে প্রতিস্থাপিত না হয়ে অন্য কোথাও প্রতিস্থাপিত হয়ে গেল তখন একে বলা হয় ‘একটপিক প্রেগন্যান্সি’। একটপিক প্রেগন্যান্সির ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে ভ্রূণ ফেলোপিয়ান টিউবেই প্রতিস্থাপিত হয়ে যায়। তাই একে টিউবাল প্রেগন্যান্সিও বলা হয়। তবে এটি ফেলোপিয়ান টিউব ছাড়াও পেটের যেকোনো জায়গায় হতে পারে, জরায়ু ব্যতীত।

ভ্রূণ যখন ফেলোপিয়ান টিউবে প্রতিস্থাপিত হয়ে যায় তখনই জটিলতা দেখা দেয়। কারণ বাড়ন্ত ভ্রূণকে রাখার মতো জায়গা এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করার মতো সামর্থ্য ফেলোপিয়ান টিউবে নেই। এই সুবিধা আছে জরায়ুতে। ভ্রূণ যদি ফেলোপিয়ান টিউবে থেকে যায় তাহলে একপর্যায়ে খারাপ হলে ফেলোপিয়ান টিউব ফেটে যেতে পারে। যদি তাই হয় তাহলে তীব্র ব্যথাসহ রক্তক্ষরণ শুরু হতে পারে। এটি অবহেলা করা একদমই উচিত নয়। কারণ ফেলোপিয়ান টিউব ফেটে এই অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ, সংক্রমণ রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে। তাই এই জটিলতা ধরা পড়ার পর দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শে চিকিৎসা নিতে হবে।

কী কী কারণে একটপিক প্রেগন্যান্সি হতে পারে :

কোনো সংক্রমণ কিংবা প্রদাহের কারণে ফেলোপিয়ান টিউব যদি আংশিক বা পুরোপুরিভাবে ব্লক হয়ে যায়
পেলভিক এরিয়া কিংবা ফেলোপিয়ান টিউবে যদি আগে কোনো অপারেশন করা হয়
জন্মগত কোনো ত্রুটির কারণেও ফেলোপিয়ান টিউবের আকার স্বাভাবিকের চেয়ে ভিন্ন হতে পারে। এবং ফলস্বরূপ টিউবাল প্রেগন্যান্সি হবার আশংকা থাকে
পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজিজ বা PID থাকলে
কোনো যৌনবাহিত রোগে আক্রান্ত হলে। যেমন, গনোরিয়া

যাদের ঝুঁকি বেশি :

মায়ের বয়স ৩৫ এর বেশি হলে
আগের একটপিক প্রেগন্যান্সির রেকর্ড থাকলে
পেলভিক এরিয়া বা তলপেটে কোনো অপারেশন করা থাকলে
আগের গর্ভপাতের রেকর্ড থাকলে
অতিরিক্ত ধূমপান
ফার্টিলিটির কোনো চিকিৎসা নিলে কিংবা ঔষধ গ্রহণ করলে

একটপিক প্রেগন্যান্সির লক্ষণ :

একটপিক প্রেগন্যান্সি হলে প্রেগন্যান্সির প্রথম দিকে কিছু লক্ষণ দেখা যায়। সেরকম কোনো লক্ষণ দেখলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

রক্তক্ষরণ হতে পারে যা কিছুটা মাসিকের মতো বা তার কাছাকাছি হবে
তলপেট এবং পেলভিক এরিয়া তে প্রচন্ড ব্যথা হতে পারে। এই ব্যাথা ঘাড় এবং কাঁধেও অনুভূত হতে পারে
শরীর খুব দুর্বল এবং মাথা ঝিমঝিম করতে পারে

একটপিক প্রেগন্যান্সি শণাক্তকরণ :

একটপিক প্রেগন্যান্সি সনাক্ত করার জন্য অবশ্যই চিকিৎসকের সাহায্য লাগবে। চিকিৎসক প্রথমে রোগীর তলপেট, পেলভিক এরিয়া পরীক্ষা করে থাকেন। এরপর আল্ট্রাসাউন্ড করে থাকেন। যাতে জরায়ুতে কোনো বাড়ন্ত ভ্রূণের উপস্থিতি আছে কিনা চেক করে দেখা হয়। hCG (human chorionic gonadotropin) হরমোনের মাত্রা ও পরীক্ষা করে দেখা হয়। কারণ আশানুরূপ এর তুলনায় কম hCG হরমোন ও একটপিক প্রেগন্যান্সির কারণে হতে পারে। এছাড়া রক্তে প্রজেস্টেরনের মাত্রা পরীক্ষা করা হয়। প্রয়োজনের তুলনায় কম প্রোজেস্টেরন ও একটপিক প্রেগন্যান্সির চিহ্ন হতে পারে।

চিকিৎসা :

একটপিক প্রেগন্যান্সিতে দুই ধরনের চিকিৎসা আছে। এক, ঔষধ গ্রহণ। দুই, অপারেশন।

চিকিৎসক রোগীকে methotrexate মেডিসিন গ্রহণের পরামর্শ দিতে পারেন। এই ঔষধ ফেলোপিয়ান টিউবে বাড়ন্ত ভ্রূণের বৃদ্ধি বন্ধ করে দেবে এবং এটি একসময় শরীরের সঙ্গে মিশে যাবে। এতে ফেলোপিয়ান টিউবের কোনো ক্ষতি হবে না।

অন্য উপায় হলো ল্যাপারোস্কোপি (Laparoscopy) করা। এই প্রক্রিয়ায় অপারেশনের মাধ্যমে ফেলোপিয়ান টিউব থেকে ভ্রূণকে অপসারণ করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় নাভির কাছাকাছি জায়গায় খুব ছোট করে একটা অংশ কেটে যন্ত্রপাতির সাহায্যে ভ্রূণকে অপসারণ করা হয়। এতে ছোট একটা ক্যামেরাও ব্যবহার করা হয় ভেতরের অবস্থা দেখার জন্য এবং এটিই সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি একটপিক প্রেগন্যান্সি অপসারণের জন্য। এতে ভ্রূণের বৃদ্ধির পরিমাণ এবং ফেলোপিয়ান টিউবের অবস্থার ওপর ভিত্তি করে টিউবের অংশবিশেষ কিংবা পুরো টিউবও অনেক সময় অপসারণ করতে হতে পারে।

একবার একটপিক প্রেগন্যান্সি ধরা পড়লে রোগী ভবিষ্যতে আবার গর্ভধারণ করতে পারবে কি না?

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটপিক প্রেগন্যান্সি ধরা পড়ার পর ভবিষ্যতে সফল গর্ভধারণ সম্ভব। তবে এটি নির্ভর করে রোগী যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসা নিয়েছিল কিনা এবং রোগীর ফেলোপিয়ান টিউবের অবস্থার ওপর। যদি এমন হয় যে, রোগীর কোনো একটা ফেলোপিয়ান টিউব বাদ দিতে হয়েছে কিংবা দুইটা টিউবই কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তখন গর্ভধারণ কঠিন হয়ে পড়ে এবং একবার একটপিক প্রেগন্যান্সি হলে এটা পরে আবার হবার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। সুতরাং গর্ভধারণ করার পর উপরের যে কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button