স্বাস্থ্য

কেন হয় ও কীভাবে বোঝা যাবে শিশুদের ক্যানসার

শিশুদের রোগক্লিষ্ট মুখ ভীষণ বেদনাদায়ক! আর রোগটি যদি হয় প্রাণঘাতী ক্যানসার, তাহলে তা অসহনীয়। কিন্তু মানতে না চাইলেও নির্মম সত্য, শিশুদেরও ক্যানসার হয়!

সারা বিশ্বে শিশুরা যে রোগগুলোতে মারা যায়, তার মধ্যে ক্যানসার অন্যতম। প্রতি বছর সারা বিশ্বে প্রায় তিন লাখ শিশু (০-১৮ বছর বয়সী) বিভিন্ন ধরণের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে শতকরা আশি ভাগ শিশুই বাস করে পৃথিবীর নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। দুঃখের বিষয় হলো, এসব দেশে অর্ধেকেরও বেশি ক্যানসার আক্রান্ত শিশু প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। এর কারণ, পরিবারের আর্থিক অসঙ্গতি এবং পর্যাপ্ত চিকিৎসা ও দক্ষ চিকিৎসকের অভাব। অথচ উন্নত বিশ্বে আধুনিক ক্যানসার চিকিৎসার কারণে শতকরা আশি ভাগেরও বেশি শিশু ক্যানসারমুক্ত দীর্ঘায়ু লাভ করে।

শিশুদের সাধারণত যেসব ক্যানসার হয়ে থাকে:

লিউকেমিয়া বা ব্লাড ক্যানসার
ব্রেইন টিউমার, মেরুরজ্জুর (স্পাইনাল কর্ড) ক্যানসার
নিউরোব্লাস্টোমা (বিশেষ ধরনের স্নায়ুকোষের ক্যানসার)
কিডনীর উইল্মস টিউমার
লিম্ফোমা (একধরণের রক্তের ক্যানসার)
র‍্যাবডোমায়োসারকোমা (মাংশপেশির ক্যানসার)
রেটিনোব্লাস্টোমা (চোখের ক্যানসার)
হাড়ের ক্যানসার (অস্টিওসারকোমা, ইউয়িং সারকোমা)

এগুলো ছাড়াও আরো কিছু ক্যানসার, এমনকি বড়দের ক্যানসারও শিশুদের হতে পারে, তবে সেটা সংখ্যায় নগন্য।

শিশুদের কেন ক্যানসার হয়?
শিশুদের কেন ক্যানসার হয়, তা আজও ধোঁয়াটে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিশুদের ক্যানসারের কোন কারণ জানা যায়নি।

মাত্র পাঁচ থেকে দশ শতাংশ ক্ষেত্রে শিশুদের ক্যানসারের জন্য জেনেটিক মিউটেশনকে দায়ী করা হয়।
ক্ষেত্রবিশেষে শিশু অবস্থায় বেশ কিছু ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে পরবর্তীতে ক্যানসার হতে পারে। যেমন এইচআইভি, এপ্সটেন বার ভাইরাস প্রভৃতি।
শিশু অবস্থায় রেডিয়েশন এর সম্মুখীন হলে অথবা ক্রমাগত পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হলে (যদি মাতা/পিতা ধূমপায়ী হয়) কিছু কিছু ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

কখন সতর্ক হবেন এবং দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন?

কোন কারণ ছাড়াই ক্রমাগত ওজন কমে যাওয়া
দীর্ঘদিন যাবত তীব্র মাথা ব্যথা (সকাল বেলা বেশি হয়), এর সঙ্গে বমি হওয়া; আর দিনে দিনে ব্যথার তীব্রতা বাড়তে থাকে
পায়ে, পিঠে, কোন গিরায় বা শরীরের কোন হাড়ে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা অথবা ফুলে যাওয়া
পেট ফুলে যাওয়া; পেটে, ঘাড়ে, বুকে, তলপেটে, কুঁচকিতে বা বগলে কোন চাকা বা ফোলা সৃষ্টি হওয়া
বারবার চামড়ার নীচে রক্তক্ষরণ হয়ে জমাট বেঁধে যাওয়া, বা শরীরের কোন স্থান থেকে রক্তক্ষরণ হওয়া
কিছুদিন পরপর বা বারবার ইনফেকশন হওয়া ও দীর্ঘদিন যাবত কাশি ও শ্বাসকষ্ট
অজানা কারণে বারবার জ্বর আসা
চোখের মনির ভেতরে সাদা হয়ে যাওয়া
হঠাৎ করে চোখের দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন, চোখ ফুলে যাওয়া বা দৃষ্টিশক্তির পরিবর্তন
সসসময় ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে থাকা, খেলাধুলায় অনীহা, নজরে আসার মতো ফ্যাকাশে ভাব
সবসময় মাথা ঘুরানো, শিশুর হাঁটায় অসঙ্গতি বা ভারসাম্য রক্ষায় সমস্যা হওয়া
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, ক্যানসার ছাড়া অন্য অনেক রোগের কারণে শিশুদের মধ্যে এধরণের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। তবে এসব লক্ষনের কোনটা দেখা গেলে অবহেলা না করে অবশ্যই দ্রুত শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া উচিৎ।

ছোটদের ক্যানসার বনাম বড়দের ক্যানসার:

বড়দের সাধারণত যেসব ক্যানসার হয় তাদের অধিকাংশই শিশুদের হয়না। শিশুদের ভিন্ন ধরণের ক্যানসার হয়।
শিশুদের বড়দের মতো পরিবেশগত কারণে, যেমন, বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, আর্সেনিক প্রভৃতি এবং অনিয়ন্ত্রিত জীবনাচরণ, যেমন, ধূমপান, অতিরিক্ত ওজন, শরীরচর্চার অভাব বা তেল-চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়ার কারণে ক্যানসার হয়না।
বড়দের তুলনায় শিশুদের ক্ষেত্রে ক্যানসার চিকিৎসা তুলনামূলকভাবে সহজ ও কার্যকর। কারণ তাদের বড়দের মতো অন্যান্য রোগ যেমন ডায়েবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাঁপানি সহ অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো থাকেনা বা খুব কম থাকে।
শিশুদের বড়দের চেয়ে বেশি বেশি ক্যানসার চিকিৎসার দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিগুলোর সম্মুখীন হতে হয়। একারণে তাদের চিকিৎসা শেষ হয়ে গেলেও নিয়মিত সতর্কভাবে চিকিৎসকের পরামর্শে থাকতে হয়।
একটি ক্যানসার আক্রান্ত শিশু ও তার পরিবারের চিকিৎসক, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও বিভিন্ন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত পেশাজীবীদের কাছ থেকে বলিষ্ঠ সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। বিভিন্ন ধরণের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক (শিশু ক্যানসার বিশেষজ্ঞসহ অন্যান্য শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ), ফিজিওথেরাপিস্ট, স্পিচ থেরাপিস্ট, পুষ্টিবিদ, সমাজসেবাকর্মী প্রভৃতি বিভিন্ন পেশার মানুষের সমন্বিত চেষ্টায় একটি ক্যানসার আক্রান্ত শিশুকে সফল ভাবে সুস্থ করে তোলা সম্ভব।

শিশুদের ক্যানসার প্রতিরোধের তেমন কার্যকর কোন পদ্ধতি নেই। একারণে সচেতনতার মাধ্যমে প্রাথমিক অবস্থাতেই দ্রুত চিকিৎসা নিয়ে শিশুকে সুস্থ করে তোলা, তাদের জন্য আধুনিক ক্যানসার চিকিৎসা ও দক্ষ চিকিৎসক এর ব্যবস্থা করা এবং তাদের সামাজিকভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button