আন্তর্জাতিক

করোনা আক্রান্তদের শরীরের অনেক অঙ্গও অকেজো হয়ে যেতে পারে

নভেল করোনাভাইরাসজনিত কোভিড-১৯ এর উপসর্গ সর্দি, হাঁচি-কাশি, জ্বর, শরীর ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া। এছাড়াও রোগটি শুধু শ্বাসযন্ত্রকেই কাবু করবে না, শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও নড়বড়ে করে দিতে পারে। সিএনএনের স্বাস্থ্য বিষয়ক এক নিবন্ধে একজন কোভিড-১৯ রোগীর অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরা হয়েছে। তবে এই ভাইরাসের আক্রমণ এতটাই ভয়াবহ যে, এর ফলে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। একইসাথে অকেজো হতে পারে অনেক অঙ্গ।

এতে জানানো হয়েছে, যিনি সংক্রমিত হওয়ার প্রথম ১০ দিন মোটামুটি ভালোই ছিলেন। নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের যেসব স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা সাধারণত বলা হয়, তাও ছিল না ৩৮ বছর বয়সী ওই রোগীর। বাসায় রেখেই তাকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল।

বাসায় থেকে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া ওই রোগীর ফুসফুসে সামান্য সমসা ছিল জানিয়ে নিউ ইয়র্কের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ শন ওয়েঙ্গারটার বলেন, জরুরিভিত্তিতে স্থানীয় এক ক্লিনিকে তাকে পরীক্ষা করা হয় এবং বাসায় থাকাটাই তার জন্য উপযুক্ত হবে বলে জানানো হয়। তার শুধু কিছুটা কাশি ছিল। ১০ দিন পরই ওই রোগীর নতুন এক উপসর্গ সবাইকে হতভম্ব করে দেয়। তার দুই পা অসাড় হয়ে গিয়েছিল আর এতটাই দুর্বলবোধ করছিল যে হাঁটতেই পারছিল না,” বলেন গুড সামারিটান হাসপাতালের ওয়েস্টচেসটার মেডিকেল সেন্টার হেলথের ভাসক্যুলার সার্জারি বিভাগের প্রধান ওয়েঙ্গারটার।

পরে পরীক্ষা করে তরুণ ওই রোগীর মূল ধমনীতে রক্ত জমাট বাঁধা দেখা যায়। শরীরের যে স্থানে ধমনী বিভক্ত হয়ে দুই পায়ের দিকে গেছে, ঠিক সেই সংযোগস্থলেই রক্ত জমাট বেঁধেছিল। ফলে তার দুই পায়ে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে তার দুই পা অসাড় হয়ে যায়। দ্রুত অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জমাটবাঁধা রক্ত অপসারণে প্রাণে বেঁচে যান ওই তরুণ।

ডা. ওয়েঙ্গারটার বলেন, এমনটা শুধু যে ৩৮ বছর বয়সী একজন রোগীর ক্ষেত্রেই হবে তা কিন্তু নয় । বিষয়টি এতটাই ভয়াবহ যে, এর ফলে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ রোগীর মৃত্যুও হতে পারে।

শুধু শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্ত জমাট বাঁধাই নয়, করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের সেবা দিতে গিয়ে চিকিৎসকরা কিডনি অকার্যকর হয়ে যাওয়া, হৃদযন্ত্রের প্রদাহ এবং রোগ প্রতিরোধ (ইমিউন) ক্ষমতায় জটিলতার মতো ভীতিকর লক্ষণও দেখতে পাচ্ছেন।

কোভিড-১৯ এর নতুন নতুন উপসর্গ নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডা কলেজ অব মেডিসিনের সহকারী অধ্যাপক স্কট বার্কেনরিজ বলেন, এটি একই সাথে কৌতুহলোদ্দীপক এবং হতাশার যে, রোগটি বিভিন্ন উপায়ে জানান দিচ্ছে।”

ডা. ওয়েঙ্গারটারের মতে, কোভিড-১৯ যেমন কারও কারও শ্বাসযন্ত্রে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, পাশাপাশি আক্রান্তদের একই সাথে বেশকিছু অঙ্গও অকেজো হয়ে পড়ার ঘটনাও দেখা গেছে। শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাতেও এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে।

নতুন করোনাভাইরাসটি শ্বাসতন্ত্রেই বেশি আঘাত করলেও এটি এখন পরিষ্কার যে আক্রান্ত কারও কারও পুরো শরীরই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

এই ভাইরাসে আক্রান্তদের স্বাভাবিক কিছু লক্ষণ হচ্ছে জ্বর, নিউমোনিয়া এবং তীব্র শ্বাসকষ্ট। কিন্তু ভাইরাসটি শরীরের আরও কিছু অঙ্গকে সরাসরি আক্রান্ত করতে পারে, যার মধ্যে একটি হচ্ছে রক্ত চলাচলকে বাধাগ্রস্ত, যা রক্ত জমাট বাঁধার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ভাইরাসটি সরাসরি রক্তনালীতে আক্রমষ করার কারণেই এটি ঘটছে,বলেন ডা ওয়েঙ্গারটার।

চিকিৎসকদের আরেকটি দল কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত অপেক্ষাকৃত তরুণ রোগীদের অনেককেই স্ট্রোকও করতে দেখেছেন। কারও কারও ফুসফুসেও রক্ত জমাট বেঁধে যাচ্ছে।

কোনো কোনো রোগীর সরু রক্তনালীতেও ছোট আকারে জমাট রক্ত পাওয়ার কথা জানিয়েছেন লস অ্যাঞ্জেলেসের সিডার্স-সিনাই মডিকেল সেন্টারের আইসিইউর চিকিৎসক ওরেন ফ্রিডম্যান।

এটা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই যে, ভাইরাসটি রক্ত জমিয়ে দিতে পারে এবং শিরা-ধমনীতে সরাসরি আক্রান্ত করতে পারে। এর অর্থ হচ্ছে পুরো শরীরই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

রক্তনালীগুলোই শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রতঙ্গকে সচল রাখে, ফলে ভাইরাসটি যদি সেগুলোকেই আক্রান্ত করে তাহলে আপনার অঙ্গগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

ডা. বার্কিনরিজ বলেন, “চিত্রটি খুবই বিভ্রান্তিকর, বিষয়টি বুঝতে আরও সময় লাগবে।”

কোভিড-১৯ এর সাথে সম্পর্কিত হতে পারে আরেকটি ভীতিকর উপসর্গ। সেটি হল- পেডিয়াট্রিক মাল্টিসিস্টেম ইনফ্ল্যামেটরি সিনড্রম’।

নিউ ইয়র্কে এ ধরনের ৫২ শিশুর খোঁজ পাওয়ার কথা জানিয়েছেন মেয়র বিল ডি ব্লাসিও। আর নিউ ইয়র্ক স্বাস্থ্য বিভাগ এ ধরনের ১০০ শিশুর বিষয়ে অনুসন্ধান করে দেখছে।

এই শারীরিক এই জটিলতায় দীর্ঘস্থায়ী জ্বর, প্রদাহ, এক বা একাধিক অঙ্গের কার্যকারিতা কমে যাওয়াসহ আরও কিছু লক্ষণ রয়েছে যার ফলে শিশুরা প্রচণ্ড আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে।

বোস্টন চিলড্রেন’স হাসপাতালের রিউমাটোলজিস্ট ম্যারি বেথ সন বলেন, “এমন আঘাতপ্রাপ্ত কিছু শিশুও আসে, পাশাপাশি কিছু শিশুর মধ্যে কাওয়াসাকি রোগও দেখা গেছে। আবার কারও কারও সাইটোকাইনের লক্ষণও দেখা দিতে পারে। কিছু এলাকায় শিশুদের মধ্যে কাওয়াসাকি রোগ বেশি দেখা গেলেও তাদের এতটা আঘাতপ্রাপ্ত হতে দেখা যায়নি।”

কাওয়াসাকি রোগের কারণে মাঝারি ধরনের রক্তনালীর দেয়ালে প্রদাহ এবং ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

চিকিৎসকরা বলছেন, ‘সাইটোকাইন ঝড়’ হিসেবে পরিচিত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ‘অতিসক্রিয়তার’ কারণে এটি হতে পারে।

নিউ জার্সির পোমোনার শিশু বিশেষজ্ঞ গ্লেন বাডনিক বলেন, ভাইরাসের বিরুদ্ধে আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে, কারণ এগুলো প্রদাহসৃষ্টিকারী রোগ। এই অতিসক্রিয়তা কাওয়াসাকির মতো রোগের কারণ হতে পারে।”

বোস্টন চিলড্রেন’স প্যানেলের কার্ডিওলজিস্ট এবং কাওয়াসাকি রোগ বিশেষজ্ঞ জেন নিউবারগার বলেন, “এটাও হতে পারে যে, সার্স-সিওভি২ এর বিরুদ্ধে শিশুদের যে অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে, সেটিও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে অতিসক্রিয় করছে।”

এই সাইটোকাইন ঝড়ের কারণে ফুফুসের ক্ষতি ছাড়াও রক্তও জমাট বাঁধতে পারে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

অন্যদিকে ডা. বার্কেনরিজ বলেন, “ভাইরাসটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া তৈরি না করে বরং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বিহ্বল করে দিচ্ছে, এমন প্রমাণও আছে।”

নেচার মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে দুই ধরনে তত্ত্বের প্রতিই সমর্থন ব্যক্ত করা হয়েছে।

চীনের শেনজেন থার্ড পিপল’স হাসপাতালের ডা. ঝেং ঝাং এবং তার সহকর্মীরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নয়জন রোগীর ফুসফুস থেকে সংগ্রহ কোষের নমুনা পরীক্ষা করেছেন এবং পরীক্ষায় প্রত্যেকের শরীরেই ‘ম্যাক্রোফেইজ’ এবং ‘নিউট্রোফিলস’ নামের রোগ প্রতিরোধী কোষের আধিক্য দেখা গেছে। পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সংকেত ব্যবস্থা অর্থাৎ সাইটোকাইন এবং কেমোকাইনের উপস্থিতিও পাওয়া গেছে রোগীদের মধ্যে।

এছাড়া টি-সেল নামের আরেকটি ইউমন কোষও বেশি দেখা গেছে তাদের মধ্যে।

কিন্তু ভাইরাসসংক্রমিত কোষগুলোকে সরাসরি ধ্বংস করতে সক্ষম সিডি৮ টি-সেলের উপস্থিতি কম পাওয়া গেছে মারাত্মক উপসর্গ ছিল এমন রোগীদের শরীরে।

চিকিৎসকরা বলছেন, এসব উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন চিকিৎসাপদ্ধতি হাতড়ে বেড়াচ্ছেন তারা।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Back to top button