বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

প্রযুক্তির যুগে নতুন প্রজন্মের ক্রিয়েটিভ চিন্তাশক্তির অধঃপতন

আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে। আমরা সবাই সাংবাদিক হয়েছি। যখনই কিছু ঘটছে বা রটছে তা সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ করছি। আমরা প্রযুক্তির মাধ্যমে সব কিছু সহজ ভাবে পেয়ে যাচ্ছি। আমরা মস্ত বড় ডাক্তার হয়েছি।

শরীরে কোনো সমস্যা দেখা দিলে গুগলে সার্চ করছি। সমস্যার কারণ এবং সমাধানের জন্য যে ওষুধের দরকার তার নাম পর্যন্ত পেয়ে যাচ্ছি। দোকানে গিয়ে বলছি আর ওষুধ কিনছি।

আমাদের কেনাকাটা করতে হবে। কে শহরে গিয়ে গরমে বা ঠান্ডায় ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করবে? বরং অনলাইনে যা দরকার অর্ডার দিলেই হলো। বাসায় রান্না করা বা থালাবাসন পরিষ্কার করার দরকার নেই। অনলাইনে অর্ডার দিলেই খাবার চলে আসছে। খাবার শেষে সব কিছু একবার ব্যবহার করে ডাস্টবিনে ফেলে দিলেই ঝামেলা শেষ।

পাশ্চাত্যে আরো মজার বিষয় তা হলো অনেকে এক রুমের মধ্যেই সব ব্যবস্থা করে নিয়েছে যাতে করে বিছানায় শুয়েই সব করা সম্ভব। যেমন রেফ্রিজারেটর বিছানার পাশেই, যখন যা দরকার হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে। টেলিভিশন, স্টেরিও একই রুমে রয়েছে, রিমোট কন্ট্রোল বিছানায়, যখন যা দরকার দিব্যি চলছে। শুধু বাথরুমে মাঝে মধ্যে যাবার জন্য বিছানা থেকে উঠতে হয়।

বই পড়া বা খবরের কাগজ পড়া, সে তো বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। কিছু জানতে গুগলে সার্চ দিলেই হলো। সময় চলে যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোরাঘুরি করে। যেমন ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ইমো, ভাইবার, ইউটিউব, হোয়াটস অ্যাপ, ইমেইল, এমএমএস, এসএমএস, মেসেঞ্জার, টিভি, বিভিন্ন মিউজিক চ্যানেল, সিরিয়াল, মুভি আরো কতকি!

এতকিছুর মধ্যে যখন হাবুডুবু খাচ্ছে তখন সময় কি আছে লেখাপড়া করার? বন্ধু বা বান্ধবীর হাতের লেখা একটি চিঠি এখন আর আসেনা। চিঠি পড়া এবং তাকে যত্ন করে রাখা, এসব এখন পুরনো গল্প যা নতুন প্রজন্মদের বললে তারা বলবে – Oh no how boring childhood you have gone through!

অথচ আমরা কিন্তু পুরাতন ঘরানার মধ্যে দিয়ে বড় হয়েছি এবং নতুনত্বের আবির্ভাব ঘটিয়েছি। উপরের যতগুলো প্রযুক্তির কথা উল্লেখ করেছি তার সব কিছুই কিন্তু আমাদের আবিষ্কার। নতুন প্রজন্ম এই মুহুর্তে শুধু এগুলোর ইউজার। তাদেরকে কিছু বললে উত্তরে বলে আমরা এখনও ছোট, আমরা দেখছি, জানছি, শিখছি। লেখাপড়া শিখে বড় হয়ে সব দায়িত্ব কর্তব্য পালন করব। তাদের কন্ট্রিবিউশন বর্তমানে শুধু বাবা-মার হোটেলে বসবাসসহ সব ধরনের সুযোগ সুবিধা ভোগ করা। বেশ চলছে তাদের জীবন, বলতে হয় নো চিন্তা ডু ফুর্তি।

এখন দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে পাশ্চাত্যে কেও ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে চাচ্ছে না। কারণ অত সময় দিয়ে লেখাপড়া করতে গেলে মজা করার সময় হারিয়ে যাবে। মজা রেখে অন্যকাজ করা অসম্ভব তাদের কাছে। নতুন প্রজন্ম গুগলে সার্চ করতে পাকা। তাদের ধৈর্য এবং সহ্য খুব কম, কারণ যা যখন দরকার তা তখনই পেতে হবে। এরা কথা বলে কম কিন্তু সারাক্ষণ ব্যস্ত নিজেদেরকে নিয়ে।

স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে এরা খুব একটা আগ্রহী নয়। কারণ সব কিছু বোরিং। এরা ঘরদুয়ার বা কাপড় চোপড় পরিষ্কার করতে পছন্দ করে না। সে দায়িত্ব বাবা-মার অথবা ক্লিনিং লেডির ওপর ছেড়ে দিয়েছে।

অনেকে রাত জেগে নানান সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যস্ত তাই দিনে দুপুরে ঘুমায় এবং ঘুম থেকে ওঠে বিকেলে। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যস্ত থাকা মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকর এবং অন্ধ অনুকরণের মধ্যে কোন কল্যাণ নেই।

আমার চিন্তা কি হবে পরবর্তী প্রজন্মের, যদি বর্তমান প্রজন্ম শুধু সুযোগসুবিধা ভোগ করে আর বিলাসিতায় মগ্ন থাকে! পরবর্তী প্রজন্ম যদি মনে করে গুগলে সার্চ করতে বোরিং লাগছে। যেমন বর্তমান প্রজন্ম ভাবতেই পারে না চিঠি লেখা, কারণ এটা বোরিং। তাহলে বর্তমান প্রজন্ম কি উপহার দেবে তাদের উত্তরসূরিদের?

বিশ্বে সর্বত্র দেখা যাচ্ছে কঠিন কাজ করতে কেও আগ্রহী নয় বিশেষ করে ধনী দেশগুলোতে। জটিল বা কষ্টের কাজগুলো করা হচ্ছে দরিদ্র দেশের ম্যানপাওয়ার অথবা রোবটের মাধ্যমে। যেমন আরবের লোকজন বাইরের লোক দিয়ে সব কাজই করাচ্ছে।

বর্তমানে প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলার মান কমতে শুরু করেছে। কারণ খেলাধুলার জন্য দরকার প্রচণ্ড কায়িক পরিশ্রমের, তাই কেও তা করতে রাজি নয়। অনেকে জিমে গিয়ে শরীরের গঠন ঠিক রাখতে বা হাত পা মাসল দিয়ে ফোলাতে বেশ সময় ব্যয় করছে। কিন্তু টেকনোলজিকে সাসটেইনেবল বা তার উন্নতি করতে হলে উচ্চতর প্রশিক্ষণের যে বিকল্প নেই তা কেও ভাবছে না!

আমাদের জানাশোনার পরিধি বাড়াতে হবে এবং চোখ-কান খোলা রেখে সন্তানদের জন্য যেটা কল্যাণকর সেটাই গ্রহণ করতে হবে। আর সন্তানদের প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির পাশাপাশি নৈতিকতাবোধকেও গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ নৈতিকতাবোধ মানুষকে ভুল ও ভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।

বর্তমান প্রজন্ম যদি রোবটের চেয়েও আরো উন্নতমানের টেকনোলজি আবিষ্কার করে পৃথিবীকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে চায়, তবে সেই কাজগুলো করতে নতুন চিন্তার দরকার! তার জন্য দরকার ক্রিয়েটিভ হওয়া। এখন যদি ক্রিয়েটিভিটির অবনতি ঘটতে থাকে এবং যদি কেও নতুন চিন্তার প্লাটফরম তৈরি না করে, তবে কি হবে পরবর্তী প্রজন্মের জীবনে? বর্তমান প্রজন্ম প্রযুক্তির ব্যবহারিক দিক দিয়ে প্রশংসনীয়। এখন তাদেরকে কিভাবে সঠিকভাবে ব্যবহার করে দক্ষ (creative ) করা সম্ভব সে বিষয় ভাবতে হবে। তাদেরকে স্মার্ট এবং ক্রিয়টিভ করতে না পারলে ভবিষ্যত হবে অন্ধকার।

মনে রাখতে হবে বর্তমান কখনও মধুময় স্মৃতি হয়ে থাকবে না মনের গভীরে, যদি নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব ঘটানো সম্ভব না হয়। বিশেষায়িত শিক্ষা প্রশিক্ষণ এবং প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য হতে হবে বর্তমান প্রজন্মের অলসতা এবং বিলাসিতাকে দূর করতে অনুপ্রাণিত করা।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button