রোহিঙ্গা ইস্যু: চার বছরে মিয়ানমারের ইচ্ছারই বাস্তবায়ন

অমানুষিক নির্যাতন, জাতিসংঘের ভাষায় গণহত্যা চালিয়েছে মিয়ানমার সরকার তাদের নাগরিক রাখাইনের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর। যে কারণে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা জীবন বাঁচাতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। গত চার বছরে মিয়ানমার সরকার একাধিকবার এই সঙ্কট সমাধানে একাধিকবার কথা দিয়েও কথা রাখেনি। পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, গত চার বছরে মিয়ানমারের ইচ্ছাই বাস্তবায়ন হয়েছে, মূল সঙ্কট সমাধানে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
এদিকে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের একাধিক শিবিরে গত চার বছরে কমবেশি দুই লাখ রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিয়েছে এবং ২৮ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা নারী এই মুহূর্তে গর্ভবতী।
এই বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. লাইলুফার ইয়াসমীন সময়ের আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। দ্রুত রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান না হলে আশ্রয় শিবিরে জন্ম নেওয়া রোহিঙ্গা শিশুদের নিয়ে ভবিষ্যতে নতুন সঙ্কটের সৃষ্টি হতে পারে। ঢাকার কূটনীতিকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সঙ্কট সমাধানে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য গত চার বছরে তিনবার মিয়ানমার সরকার ঘোষণা দিয়ে একবারও তা বাস্তবায়ন করেনি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য রাখাইনে এখনও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেনি মিয়ানমার। সর্বশেষ গত ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে ঢাকার সঙ্গে এই বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো বার্তা বিনিময় করেনি নেপিডো। ঢাকার কর্মকর্তারা বলছেন, গত ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত দফায় দফায় নেপিডোর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের কাছ থেকে জবাব পাওয়া যায়নি।
অধ্যাপক ড. লাইলুফার ইয়াসমীন সময়ের আলোকে বলেন, ‘ক্যু হওয়ার পর রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের কোন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশ আলাপ চালাবে তা এখনও পরিষ্কার নয়। ফলে রোহিঙ্গা সঙ্কট আরও দীর্ঘায়িত হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। আবার এখন যে জান্তারা মিয়ানমার শাসন করছে, তারাই ২০১৭ সালে গণহত্যা ঘটায়। তাই তাদের সঙ্গে আলোচনায় ভালো ফল আসবে বলে মনে হয় না।’
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক এই বিষয়ে সময়ের আলোকে বলেন, মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর ভিন্ন পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এতে রোহিঙ্গা ইস্যু অনেক পড়েছে। অধ্যাপক ড. লাইলুফার ইয়াসমীন বলেন, ‘সবার দৃষ্টি এখন আফগানিস্তান ইস্যুতে। যে কারণে রোহিঙ্গা সঙ্কট পিছিয়ে আছে। রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে ইস্যুটিকে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনায় রাখতে হবে।’
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে বিশ্ব নেতারা মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির বদলে মানবিক সহায়তামূলক কর্মকাণ্ডের প্রতি নজর দিতেই বেশি আগ্রহী। আঞ্চলিক শক্তিগুলোও এক্ষেত্রে দায়িত্বশীল আচরণ করছে না। এই বিষয়ে অধ্যাপক ড. লাইলুফার ইয়াসমীন বলেন, এটা ঠিক বিশ্ব নেতারা চাপ প্রয়োগ করলে মিয়ানমার এই সঙ্কট সমাধানে বাধ্য। কিন্তু সবাই নিজেদের স্বার্থ আগে দেখে। সবারই কমবেশি মিয়ানমারে স্বার্থ আছে, তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য আছে। যে কারণে পশ্চিমা শক্তি চাপ প্রয়োগের চেয়ে মানবিক সহায়তা কার্যক্রমের প্রতি বেশি মনোযোগী। তিনি আরও বলেন, আঞ্চলিক শক্তিগুলোর অবস্থানও এক্ষেত্রে একই। জাপান-চীন প্রকাশ্যেই মিয়ানমারকে সমর্থন জানিয়েছে। ভারত প্রকাশ্যে সমর্থন না দিলেও তাদেরও সেখানে স্বার্থ থাকায় মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করে না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ৬ আগস্ট সময়ের আলোকে বলেন, ‘আজ আসিয়ানের বৈঠকে মিয়ানমারের প্রতিনিধি রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে বলেছে, তারা এই ইস্যুতে দ্বিপক্ষীয়ভাবে কাজ করতে চায়। আমি ওই বৈঠকে বলেছি, যদিও বাংলাদেশ ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশন বা ১৯৬৭ সালের প্রটোকলে স্বাক্ষর করেনি, তারপরও শুধুমাত্র মানবিক দিক বিবেচনায় বাংলাদেশ এক দশমিক এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষে অনির্দিষ্টকালের জন্য এই বোঝা বহন করা সম্ভব নয়। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বিশ্ব নেতাদের সহযোগিতা প্রয়োজন।’
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন এই প্রতিবেদককে বলেন, মিয়ানমার সরকার বহুবার সঙ্কট সমাধানে কথা দিয়েও বাস্তবে কিছুই করেনি। এবারও যে কথা রাখবে তাতে তেমন কোনো ভরসা পাচ্ছি না। সঙ্কট মেটাতে বাংলাদেশকে কমপক্ষে পাঁচ থেকে ১০ বছরের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগুনো প্রয়োজন।