রংপুর বিভাগসারাদেশ

বাবা ভ্যানচালক, মা চা বিক্রেতা, ফুটবল প্রশিক্ষণে মেয়ে যাচ্ছে পর্তুগাল

রাণীশংকৈলে, (ঠাকুরগাঁও) প্রতিনিধিঃ ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার রাঙাটুঙ্গী ইউনাইটেড মহিলা ফুটবল একাডেমির খেলোয়ার কাকলী আক্তার দেশের গণ্ডি পেরিয়ে  বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। তিন মাস উন্নত ফুটবল প্রশিক্ষণের জন্য পর্তুগাল যাচ্ছেন কাকলী। বুধবার ১ জুন সরেজমিনে গিয়ে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এতে করে এলাকাজুড়ে তার পরিবার ও এলাকাবাসির মধ্যে অনেক আনন্দ বিরাজ করছে। উপজেলার  পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবুল কাশেম ও বানেসার মেয়ে কাকলী আক্তার (১৬)। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট কাকলী।
নিজস্ব বসতভিটা ছাড়া আবাদি কোনো জমি নেই কাকলীদের। ঋণের টাকায় একটি ভ্যান কেনেন তার বাবা। সেই ভ্যান চালিয়ে যা আয় হয়, তা দিয়েই চলে ভরণপোষণ। আয়ের তুলনায় পরিবারের চাহিদা বেশি তাদের। তবে কিছুই করার নেই। উপার্জন আসার কোনো রাস্তা ছিল না তাদের। কষ্ট করে সংসার চালিয়ে নিতেন কাকলীর মা বানেসা। দিন আসে দিন যায়, অভাব দূর হয় না তাদের। মাঝখানে কাকলীর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে বসেন। যেন আকাশ ভেঙে পড়ল কাকলীর মায়ের ওপর। একে তো অভাবের সংসার, তার ওপর অশান্তি, দুটো যুক্ত হয়ে জীবন হলো বিষময়। তবে বাস্তবতাকে মেনে নিতে সংকোচ বোধ করেননি তার মা। নিজের কাছে জমানো কিছু টাকা দিয়ে শুরু করেন চা বিক্রি। রাস্তার ধারে ছোট একটি দোকানে চা বিক্রি করেই পরিবার ও কাকলীর অর্থের জোগান দিয়েছেন তিনি।
কয়েক বছর পর কাকলীর বাবা নিজ ভুল বুঝতে পেরে দ্বিতীয় সংসার ছেড়ে আবার ফিরে আসেন তাদের কাছে। পরে সব মেনে নিয়ে আবার সংসার চলা শুরু হয় তাদের। বর্তমানে অসুস্থ বয়োবৃদ্ধ বাবা চালান ভ্যান আর মা করছেন চা বিক্রি। তবে মেয়ের ভিনদেশে যাওয়ার কথা যেন সব কষ্ট ভুলিয়ে রেখেছে তাদের।
কাকলীর মা বানেসা বলেন, ‘মেয়েডা আমার ফুটবল খেলে। নানান জনে নানা ধরনের খারাপ কথা কহে। খারাপ লাগিলেও মেয়েডা কান্নাকাটি করত আবার যাইত খেলতে। হামার থাকবার জায়গা ছাড়া আর কিছু নাই। স্বামী ভ্যান চালায় আর আমি চা বিক্রি করি। এখন আমার মেয়েডা বাইরের দেশত যাছে, এটা গর্বের বিষয়। সবাই দোয়া করবেন তার জন্য।’
কাকলীর বাবা আবুল কাশেম বলেন, ‘আমি দিনমজুরি করে সংসার চালাতাম। পরে একটা ভ্যান নিয়ে চালানো শুরু করি। এখনো ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাই। আর কাকলীর মা চা বিক্রি করে। আমি বয়সের কারণে নানা রোগে ভুগতেছি। পায়ের সমস্যা লেগেই আছে। মেয়েটা পর্তুগাল যাচ্ছে প্রশিক্ষণে, এটি আমার কাছে অনেক আনন্দের। যেখানে যাই সেখানকার লোকজন খোঁজখবর নেই। চা খাওয়ায় আর কাকলীর গল্প করে। তখন বুকটা ভরে উঠে। আমার মেয়ের জন্য সকলে দোয়া রাখবেন।’
কাকলী আক্তার  বলেন, ‘স্কুল পর্যায়ে যে বঙ্গমাতা ফুটবল খেলাগুলো হতো, সেখান থেকেই আমার শুরু। পরে আমার এক স্যার বললেন, আমি ফুটবলার হবো কি না। আমি বলেছিলাম, যদি ভালো সুযোগ পাওয়া যায় তাহলে হব। পরে তিনি আমাকে রাঙাটুঙ্গিতে যোগাযোগ করিয়ে দেন। আমি বাবা-মাকে বিষয়টি বলি। তারা আমাকে সহযোগিতা করেছেন এবং ফুটবল কিনে দিয়েছেন। এখন দেশের বাইরে যাচ্ছি আরও উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য। এটি আসলে অনেক বড় আনন্দের খবর আমার কাছে। তবে এ আনন্দের পেছনে অনেক পরিশ্রম রয়েছে। মেয়ে হিসেবে ফুটবল খেলতে এসে নানা ধরনের কটু কথা শুনতে হয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে রাঙাটুঙ্গি ইউনাইটেড মহিলা ফুটবল একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক তাজুল ইসলাম বলেন, ‘অনূর্ধ্ব-১৭ জাতীয় চ্যাম্পিয়ন দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ১১ জন ছেলে ব্রাজিলে ও ১১ জন মেয়ে পর্তুগালে ফুটবল প্রশিক্ষণের জন্য যাচ্ছে। সেরা এগারোর মধ্যে আমাদের ঠাকুরগাঁও জেলা থেকে একজন নির্বাচিত হয়েছেন। কাকলী নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে। তার বাবা বয়োবৃদ্ধ মানুষ। ভ্যান চালান। কিন্তু এ বয়সে ঠিকমতো চালাতে পারেন না। ভ্যানই একমাত্র আয়ের উৎস তাদের। আর তার মা চা বিক্রি করেন। তাদের জন্য এ ঘটনা অনেক বড় কিছু।’
এমন খুশির খবর শুনে রাণীশংকৈল পৌরসভার মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমার পৌরসভার এক হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান কাকলী। কাকলীর মা-বাবা কষ্ট করে তাদের সংসারের খরচ চালায়। আজ সে ফুটবলের উচ্চ প্রশিক্ষণের জন্য পর্তুগাল যাচ্ছে, বিষয়টি আমাদের পৌরসভার জন্য খুবই খুশির খবর।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button