জাতীয়

এক সিদ্ধান্তে অনেক দুর্ভোগ, বারলো ঝুকি

চলমান বিধিনিষেধের মধ্যে গার্মেন্টস ও কলকারখানা খুলে দেওয়ার বিষয়ে সরকারের আকস্মিক ঘোষণায় গতকাল শনিবার থেকে ঢাকামুখী মানুষের ঢল নেমেছে। লকডাউনের কারণে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় কিছু পথ হেঁটে, এর পর ছোট যানে আরও কিছুটা এগিয়ে ফেরি এবং তার পর সড়কে নানাভাবে ভোগান্তির পথ মাড়িয়ে ঢাকায় ফিরেছেন পোশাক শ্রমিকরা। ঢাকার আশপাশের জেলাগুলো থেকে ট্রাক, পিকআপভ্যান, কভার্ডভ্যান, ইজিবাইক, মোটরসাইকেল, সাইকেলসহ ছোট ছোট যানে ঢাকায় আসতে দেখা যায়। সঙ্গে অতিরিক্ত ভাড়া আর নানা বিড়ম্বনা তো ছিলই। ‘যথাসময়ে না এলে চাকরি থাকবে না’Ñ এমন আশঙ্কায় হন্যে হয়ে ঢাকার

পথ ধরেন তারা। অবশ্য দুর্ভোগের দিনশেষে শ্রমিকদের কর্মস্থলে ফেরা নির্বিঘœ করতে রাত ৮টার দিকে বিআইডব্লিউটিএ জানায়, রাত থেকে লঞ্চ চলাচল শুরু হয়েছে। আজ (রবিবার) দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলাচল করবে যাত্রীবাহী সব লঞ্চ। পাশাপাশি শনিবার রাত থেকে রবিবার পর্যন্ত সারাদেশ থেকে শ্রমিকদের ঢাকা নিয়ে আসার জন্য বাস চলাচলেরও অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এসব ঘোষণা যখন এলো ততক্ষণে ঢাকায় ফিরে এসেছেন লাখ লাখ মানুষ।

এমন সব সিদ্ধান্তে স্বভাবতই প্রশ্ন জেগেছে- তা হলে এই লকডাউনের অর্থ কী? বিশ্লেষকরা বলছেনÑ সরকারের এক খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত সব শেষ করে দিল। লকডাউনের দুই সপ্তাহ পর যে সুফল পাওয়া যেত, তা বিফলে যাবে। উল্টো ফেরি ও বিভিন্ন যানে গাদাগাদি করে কর্মস্থলে ফেরার মাধ্যমে করোনা সংক্রমণ আরও বাড়বে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

এবারের লকডাউন সবচেয়ে কঠোর হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল সরকারের পক্ষ থেকে। অথচ ব্যবসায়ীদের অনুরোধে ১ আগস্ট থেকে শিল্পকারখানা চালুর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। লকডাউনের মাঝপথে এমন সিদ্ধান্ত সবাইকেই হতবাক করেছে। এর মধ্যে আবার একদিনেই কীভাবে লাখ লাখ মানুষ ঢাকায় ফিরবে, তার ব্যবস্থা করা হয়নি। সরকার, বিজিএমইএ কিংবা কারখানা কর্তৃপক্ষÑ কেউই শ্রমিকদের কর্মস্থলে ফেরার যানবাহনের ব্যবস্থা করেনি। উল্টো সময়মতো কাজে না ফিরলে ব্যবস্থা নেওয়ার হুশিয়ারি দিয়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষÑ এমনটি জানিয়েছেন শ্রমিকরা। এ পরিস্থিতিতে যে কোনো উপায়ে ঢাকায় ফিরতে মরিয়া দেখা গেছে সবাইকে। দিনভর পথে পথে দুর্ভোগ সঙ্গী করে ঢাকায় ফিরেছেন তারা।

সরকারের এমন সিদ্ধান্তে হতবাক হয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘এটা অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত। একটি পক্ষকে সুবিধা দিতে এ সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। কে কত লবিং করতে পারেন তার ওপর সরকার সিদ্ধান্ত নেয়।’ তিনি বলেন, ‘কারখানা বন্ধ থাকলে অনেক ক্ষতি হবেÑ এমন যুক্তি দেখিয়েছে বিজিএমইএ। একই যুক্তি তো দোকান মালিকদের আছে, অন্যদেরও আছে। একই যুক্তি তো ছাত্র-ছাত্রীদেরও। অন্য কারও দাবি তো সরকার কানে নেয়নি। শুধু একটি গ্রুপের দাবি সম্পূর্ণ অসঙ্গতিভাবে ঢাকায় ফেরার কোনো ব্যবস্থা না করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে শুধু শ্রমিকের ভোগান্তি বাড়াল না, তাদের আর্থিক ক্ষতিও হলো। পাশাপাশি সংক্রমণ বাড়ানোর পথ তৈরি করল।’ এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘শ্রমিকদের কাজে নেওয়ার জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করবে কারখানা কর্তৃপক্ষ; কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো কারখানা এমন ব্যবস্থা নিতে শোনা যায়নি। তাই শ্রমিকরা গাদাগাদি করে ঢাকায় ফিরছেন। তাদের এভাবে যাতায়াতের কারণেই করোনা বেশি ছড়াচ্ছে; কিন্তু সরকার কারখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। শ্রমিকরাও জানেন যে, তাদের চাকরি গেলে সরকার মালিকদের কিছু করবে না। এ কারণেই তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চাকরি বাঁচাতে ছুটছেন।’

কোরবানির ঈদের আগে যে ‘বিধিনিষেধ’ কার্যকর ছিল, তা-ও কঠোর হওয়ার ঘোষণা দিয়ে সরকার ঈদের কারণে উঠিয়ে নেয়। সেই বিধিনিষেধও বেশ ঘোষণা দিয়ে কঠোরভাবে পালন করা হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। এবারও কঠোরভাবে ঘোষণা দিয়ে অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত নিল সরকার। অথচ মাত্র কয়েকদিন আগেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছিল বিজিএমইএ নেতারা। তখনো বলা হয়েছিলÑ ৫ আগস্ট পর্যন্ত লকডাউন চলবে, কলকারখানা বন্ধ থাকবে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের উদ্যোগে বৃহস্পতিবার এক দল ব্যবসায়ী মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে বৈঠক করে যত দ্রুত সম্ভব শিল্পকারখানা খুলে দেওয়ার অনুরোধ করে। এর এক দিন পর শুক্রবার ঘোষণা আসে- রবিবার সকাল থেকে রপ্তানিমুখী সব শিল্পকারখানা খুলবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৫ আগস্ট লকডাউন শেষ হওয়ার কথা ছিল। আর কারখানা খুলছে আজ ১ আগস্ট। ১ থেকে ৫ আগস্ট তো বেশিদিন নয়। কয়েকদিনের জন্য কারখানার কী এমন ক্ষতি হতো? যদি তা-ই হয়, শ্রমিকদের কর্মস্থলে ফিরতে অন্তত ৩ থেকে ৫ দিন সময় দেওয়া দরকার ছিল। এভাবে দুর্ভোগের সঙ্গে করোনার সঙ্গী কেন করা হলো লাখ লাখ মানুষকে।

আমাদের ব্যুরো অফিস এবং জেলা উপজেলা প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, ঢাকা ফিরতে লকডাউন উপেক্ষা করে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ও মাদারীপুরের শিবচরের বাংলাবাজার ঘাট দিয়ে যাত্রীরা হন্যে হয়ে ছুটছেন। যাত্রীরা গাগাগাদি করেই উত্তাল পদ্মা পার হতে দেখা গেছে। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় তিন চাকার বিভিন্ন গাড়ি ও মোটরসাইকেলে করে অনেককে বাংলাবাজার ঘাটে আসতে দেখা যায়। সেখান থেকে ফেরিতে উঠছিলেন তারা। স্বাস্থ্যবিধি বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বালাই নেই। ভোলার ফেরিতে উপচে পড়া মানুষের ভিড় ছিল। মানুষের ভিড়ে ফেরিতে গাড়ি উঠানো যাচ্ছিল না। শনিবার সকাল থেকে ভোলার ইলিশা ঘাটে এ চিত্র দেখা গেছে। ঢাকায় যেতে বাস না পেয়ে রংপুরে সড়ক অবরোধ করেছেন যাত্রীরা। ঢাকা-ঝিনাইদহ মহাসড়কে যানবাহন না পেয়ে বিভিন্নভাবে এক জেলা থেকে আরেক জেলা হয়ে ঢাকামুখী মানুষের ভিড় দেখা গেছে। পদ্মা পার হওয়ার পর রাজধানীতে যেতে অনেককে কভার্ডভ্যান, নসিমন ও ইজিবাইকে উঠতে দেখা যায়। ভাড়া বেশি চাওয়ায় অনেকে হেঁটেই ধরেছেন ঢাকার পথ। বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম সংযোগ মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কগুলোসহ পাবনার কাজিরহাট ফেরিঘাটে সকাল থেকেই উপচেপড়া ভিড় দেখা যায়। বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম সংযোগ মহাসড়ক এবং আঞ্চলিক সড়কগুলোয় হাজার হাজার মানুষের ভিড় দেখা গেছে। সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল, পাঁচলিয়া, কড্ডার মোড় থেকে ট্রাক, মাইক্রোবাস, পিকআপ, অ্যাম্বুলেন্সসহ নানা যানবাহনে গাদাগাদি করে বৃষ্টির মধ্যে তাদের যেতে দেখা যায়।

বিআইডব্লিউটিসির বাংলাবাজার ঘাটের ব্যবস্থাপক মো. সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রবিবার থেকে গার্মেন্টস ও কলকারখানা খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। ফলে হাজার হাজার যাত্রী। লকডাউনে লঞ্চ ও স্পিটবোট চলাচলও বন্ধ। ফলে যাত্রীরা গাদাগাদি করে ফেরিতেই উঠছিলেন।

শিমুলিয়া ও পাটুয়ারি ঘাটে অনেক শ্রমিকই বলেছেন, গার্মেন্টস খোলা, তাই কর্মস্থলে যেতেই হবে। নইলে চাকরি চলে যেতে পারে। অতীতেও যথাসময়ে কাজে যোগ না দেওয়ায় অনেক শ্রমিকের চাকরি গেছে। আর এখন তো করোনার সময়। কথায় কথায় অনেকের চাকরি যাচ্ছে।

দিয়া আক্তার নামে এক নারী পোশাককর্মী বলেন, শুক্রবার রাতে অফিস থেকে ফোন দিয়ে সঠিক সময়ে অফিস যেতে বলা হয়েছে। নইলে চাকরি থাকবে না।

রাতে গাবতলী ও গাজীপুর চন্দ্রা মোড়ে হাজার হাজার মানুষকে ঢাকায় প্রবেশ করতে দেখা গেছে। সাভার এলাকায় হাজার হাজার কর্মী প্রবেশ করেছেন। গাবতলী দিয়ে মানুষ প্রবেশ করেছেন। ঢাকামুখী প্রত্যেকটি সড়কে ছোট ছোট যানে মানুষকে প্রবেশ করতে দেখা গেছে।

তবে শনিবার সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ জানিয়েছে, বিধিনিষেধ পুরোপুরি প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত গ্রামে অবস্থানরত কোনো পোশাকশ্রমিক-কর্মচারী কারখানায় কাজে যোগদান করতে না পারলে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। এ সময়ে কারখানার আশপাশে অবস্থানরত শ্রমিকদের নিয়ে উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কারখানার মালিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি।

মহামারী নিয়ন্ত্রণের লকডাউনের মধ্যে কারখানা খুলে দেওয়া সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছে বিভিন্ন বাম সংগঠন। পৃথক বিবৃতিতে সরকারি এই সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়ে সংগঠনগুলো বলছে, এর ফলে শ্রমিকদের ‘ঝুঁকির’ মধ্যে ফেলে দেওয়া হলো। বাম গণতান্ত্রিক জোট লকডাউনের বিধিনিষেধের মধ্যে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ও মৃত্যু ঊর্ধ্বমুখী সত্ত্বেও রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা খুলে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। লকডাউনের মধ্যে কারখানা খুলে দেওয়ায় শ্রমিকদের ‘দ্বিমুখী সংকট’-এ ঠেলে দেওয়া হয়েছে মন্তব্য করেছে গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্ট।

আলাদা এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান কঠোর লকডাউনে রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা খুলে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তকে ‘চরম অবিবেচনাপ্রসূত ও অমানবিক’ আখ্যা দিয়েছেন।

জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক মোজাহেরুল হক আমাদের সময়কে বলেন, এভাবে মানুষ ফিরলে সংক্রমণ তো বাড়বে। সরকার যেভাবে লকডাউন দিয়েছে, তা সঠিকভাবে প্রতিপালন হয়নি। প্রতিপালনের ক্ষেত্রে জনগণ তেমন সম্পৃক্ত হয়নি, পাশাপাশি সরকার এটা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেনি। জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া লকডাউন বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। জনগণ তো সম্পৃক্ত হচ্ছে না।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button